You are currently viewing জনসম্মতি ও জনঅংশগ্রহণ কিউবাকে রক্ষার একমাত্র পথ

জনসম্মতি ও জনঅংশগ্রহণ কিউবাকে রক্ষার একমাত্র পথ

‘কিউবা কেন মুরগী বানায় না?’ হঠাৎ মুরগী ও কিউবা বিষয়ক এই আলাপে চমকে গেছিলাম, জাতি হঠাৎ কিউবা ও মুরগী বিষয়ে হঠাৎ কেন সরব হয়ে উঠলো? পরে বোঝা গেলো বাঙালী জাতি নয় শুধু, দুনিয়া জুড়েই এই প্রশ্নটা সম্প্রতি জোরেশোরে উঠছে: সমাজতন্ত্র এত অদক্ষ যে কিউবানরা মুরগিও বানাতে পারে না!

কিউবা কি মুরগী বানাতে পারে না বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে? আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে মুরগি মরে যায়? জাতিকে অলস বানিয়ে ফেলেছে ক্যাস্ট্রোর শাসন?

প্রশ্নটা আসলেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যদি উত্তরটা জানার আগ্রহ থাকে। এটা একটা ভুল প্রশ্ন হবে যদি সেটা আগেই ধরে নেয়া হয় যে, কিউবানরা এতটা অযোগ্য যে তারা মুরগি বানাতে পারে না! কেননা, কিউবা ইতিমধ্যেই বহুবার বহুভাবে উলটোটা প্রমাণ করেছে, জাতি হিসেবে তারা যা-যা অর্জনযোগ্য বলে মনে করেছে, তারা সেটা বাস্তবে করে দেখিয়েছে। সেইকারনেই, কথার কথা হিসেবে মুখে মুখে মানলেই হবে না যে, কিউবা তার শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করেছে, চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করেছে– যদি আমরা তার উন্নতির গভীরতাটা বোঝার চেষ্টাটা সৎভাবে না করি। বরং সেটা অর্জন করতে গেলে একটা গোটা জাতিকে কতটা গভীর থেকে বদলে নিতে হয় যে ল্যাতিন আমেরিকা আর ক্যারিবিয়ার মাঝে সম্পদের দিক দিয়ে অন্যতম দরিদ্র জাতিটা সম্পদশালী জাতিগুলোর চাইতে জীবনমানের সূচকে এত উঁচুতে চলে যায়, সেই বিষয়টুকু আমাদের হৃদয়ঙ্গম করতে হবে।

বরং ‘কিউবায় কেন মুরগী হয় না’ প্রশ্নটার উত্তর আমাদের বিশ্বব্যাপী আলোচিত নতুন একটি প্রসঙ্গের দিকে নিয়ে যায়। সেটা হলো খাদ্য নিরাপত্তা। কিউবায় খুব ভালোই মুরগি হতো, নিকট অতীতেও তারা নিজেদের মুরগী নিজেরাই বানিয়েই খেতো। কিন্তু কিউবায় মুরগী উৎপাদনের চাইতে মুরগী আমদানি করলে খরচা কম হয়, এই সহজ অর্থনৈতিক যুক্তিতেই কিউবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুরগি আমদানি করে, বহু বছর ধরেই।

ধরনের দিক দিয়ে কিউবার মুরগী সমস্যার এই সমাধানটি বরং অত্যন্ত স্থুল ধরনের ‘পুঁজিবাদী’ মনোবৃত্তির। কিউবার বরং উচিত ছিল, বা বলা যায় যে কোন রাষ্ট্রেরই উচিত জনগণের খাদ্য নিরাপত্তার মত প্রশ্নকে বাজারের অন্ধ প্রক্রিয়ার হাতে ছেড়ে না দেয়া, অন্তত যতদূর সম্ভব। কেননা, স্বাভাবিক সময়ে তা ঠিকঠাক কাজ করলেও যে কোন বিপর্যয়ের সময়ে মানুষের পাতে টান পড়ে। পেঁয়াজ নিয়ে, ডাল নিয়ে এবং আরও বহু বিষয় নিয়ে আমরাও কখনো কখনো সেই রকম সমস্যা দেখেছি বাংলাদেশে। যদিও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অতি সৌভাগ্যবান, প্রকৃতি আমাদের দুই হাতে দিয়েছে বলে দুর্ভিক্ষের বছরগুলোতে ছাড়া অত শক্তভাবে একদিকে আমরা টের পাইনি কৃষির বিনির্মাণ কেন প্রয়োজন, আরেকদিকে জাতিগতভাবে কিউবার তুলনায় বহু বহু গুন কম আমিষ খেয়েও আমরা বাজারের নিজস্ব শক্তির প্রশংসা করে যেতে পারি। কিউবার তুলনায় আমরা রীতিমত ‘সুজলাসুফলা শস্য শ্যামলা’ ভূমি।

আসলে জাতিগত আলস্য (কিংবা গোঁড়ামি) না থাকলে কিউবার মুরগি উৎপাদনের দক্ষতা বা মার্কিনী অবরোধ কিউবাকে পঙ্গু করে রাখায় ভূমিকা রাখছে কি না, সেই সব প্রশ্নগুলো আদৌ উঠতো না বাজারে। কিউবায় মার্কিন অবরোধের মানবিক ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ে জাতিসংঘের খুবই বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদনও আছে, সেগুলো ঘেঁটে নিলেই চলতো। খুবই স্থুল আরেকধরনের যুক্তি পাওয়া যায়: ভাই কিউবা যদি স্বর্গরাষ্ট্রই হবে, তাইলে কিউবার লোকে কেন আমেরিকা যায়! এই প্রশ্নকারীদের কোনদিন বোঝানো যাবে না যে, কিউবা কোন স্বর্গরাষ্ট্র নয়, বরং বলা যায় কিউবা এমন একটা দেশ যেখানে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে গম হয় না, মাটি অনুর্বর বলে ধানও হতো না তেমন একটা । গত কয়েক বছরে কোন কৃত্রিম সার ব্যবহার না করে কিউবা এই সারের সংকট সমাধান করেছে স্রেফ নাইট্রোজেনসমৃদ্ধ ফসল পরিকল্পিতভাবে ধানের জমিতে চাষ করে, এবং এটাকে মার্কিন একটি সরকারী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন পর্যন্ত বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ বলেছে মাত্র বছর পাঁচেক আগে। মার্কিন গবেষকরা বলেছেন এটা মার্কিনীদের জন্যও শিক্ষণীয় (কেননা বিপুল উৎপাদন ও জমিতে প্রয়োগ ক্ষতিকর, অপচয়মূলক)। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের বরং বলা উচিত ছিল যে কিউবার এই সুদক্ষ উদ্ভাবন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যও জীবনদায়ী হতে পারে। কেননা জমিতে নাইট্রোজেন দেয়ার নামে আমাদের অর্থনীতিতে বৃহত্তম লুণ্ঠনগুলোর একটা হয়, সারের ভর্তুকি বাবদ।

ফলে কিউবার পদ্ধতির অযোগ্যতা বা অদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আসাটা রীতিমত বিব্রতকর, কেননা প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়ে বাংলাদেশের চাইতে বহুগুন দরিদ্র একটা অঞ্চল কিউবা বহু বহু গুন বেশি দক্ষতার দৃষ্টান্ত দুনিয়ার সামনে স্থাপন করে বসে আছে। মুরগি নিয়েই যখন এবার প্রশ্নটা উঠেছে, হৈচৈ হচ্ছে, অপেক্ষা করুন, বড়জোর পাঁচ বছরের মাথায় কিউবা তাদের মুরগি সমস্যারও পরিবেশ সম্মত, গ্রহণযোগ্য এবং স্বাস্থ্যকর সমাধান হাজির করবে।

প্রশ্নটা আসলে হওয়া উচিত কিউবার শাসন পদ্ধতি নিয়ে। এতে কোন সন্দেহ নাই যে, কিউবার যা কিছু অর্জন সেটা তার বিপ্লবের ফল। একই কথা চীন কিংবা ভিয়েতনামের জন্যও সত্য। প্রত্যেকেই তার যাত্রা শুরুর বিন্দু থেকে এত এত বেশি এগিয়েছে যে ‘বাজারের শক্তির’ ভরসায় থাকা বড়জোর একটা দুটো দেশ অগ্রগতিতে তাদের সাথে তুলনীয়। কিন্তু ভবিষ্যতের প্রশ্নটা আসবে আসলে এই ‘বিপ্লবী’ রাষ্ট্রগুলোর শাসনপদ্ধতি নিয়েই। এটা নগরায়িত চীন, ভিয়েতনাম কিংবা কিউবা, কাউকেই ছাড় দেবে না।

সমস্যা হলো বাংলাদেশে একদিকে যেমন কিউবার অর্জনগুলো নিয়ে শিশুসুলভ প্রশ্ন তোলা হয় (অদক্ষতা ইত্যাদি), যেগুলো আলাপটাকে আরও কয়েকধাপ পিছিয়ে নিয়ে যায়, আরেকদিকে এই শাসনতন্ত্র বিষয়ক প্রশ্নগুলো তুলতে গেলে আসে ‘বামপন্থী’ সাফাই: আপনি আমেরিকায় প্রতিদিন কয়জনপুলিশের গুলিতে মারা যায়, সেই কথা তো বললেন না! আমেরিকা যে তার সমাজে বর্ণবৈষম্যের সমস্যা সমাধান করতে পারেনি, সেই কথা তো তুললেন না! কিংবা, কিউবাকে কিউবার মত থাকতে দাও!

এই হলো বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বামপন্থী ধারাবাহিকতার সমস্যা। সৃজনশীল তরুণদেরও বহুক্ষেত্রে এটা বদ্ধ চিন্তা দিয়ে নতুন সমস্যার সমাধানে ব্যাপৃত করে, ফলে অজস্র তথ্যের উপস্থাপন থাকলেও সমস্যার মূলটা অধরা থেকে যায়। এটা আরও জটিল হবে যখনই আপনি চীন বা রাশিয়ার একদলীয় এবং আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতির সমালোচনা তুলবেন। তারা দেখাবেন: বা দাবি করবেন স্তালিন বা মাও পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল, তারপর… এক দুষ্টু লোক… ষড়যন্ত্র… চক্রান্ত। প্রশ্নটা এইখানেই: যদি ধরেও নেই যে মাও কিংবা স্তালিন জ্ঞাতসারে কোন অন্যায় করেননি, কিন্তু তাও, তাদের মৃত্যুর পর, তারপর ঠিক কী ঘটে? সবগুলো দেশেই, ব্যতিক্রমহীনভাবে?

যা ঘটে তার একটা ব্যাখ্যা মোটামুটি এই। যখনই আপনি জনগণের শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দল, আমলাতন্ত্র, গোয়েন্দা পুলিশ আর নানান গোপন শক্তির ওপর বেশি বেশি নির্ভর করা শুরু করবেন, জনগণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরতে থাকবেন। বিপ্লবের তথাকথিত প্রমাণিত ‘শত্রুদের’ যদি ভুল কায়দায় উঠিয়ে এনে বিচার করা শুরু করেন, একসময়ে এই কায়দাই শক্তিশালী হয়ে যাবে, এবং খাঁটি বিপ্লবীরা পরলোকে গমন করলেও পেছনে রেখে যাবেন এই ভীতিকর কায়দাকে। সেটাই যে রাশিয়াতে ঘটেছিল, তার প্রমাণ হলো স্তালিনের মৃত্যুর পর এই কায়দা যাকে এবং যাদেরকে বাছাই করেছিল, তারাই নিজেদের মত করে দেশ চালিয়েছেন। সাধারণ জনগণ কী মনে করে, তাদের মতামত কী, সেটা আর বিবেচ্য থাকেনি। কেননা, সঠিক নেতারাই জনগণের ওপর এই শক্তিগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

চীনের কপাল ভালো যে মাও সে তুং এর পর দেং এর মত যোগ্য এবং সংস্কারপন্থীকে তারা পেয়েছিল, তিনি এই বিপুল পার্টি, সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে ৭০ পরবর্তী বিশ্ববাস্তবতায় ও চীনের চাহিদার ভিত্তিতে দেশটার দিকনির্দেশনা ঠিক করতে পেরেছেন, ভুলত্রুটি সমেত। কিন্তু এটিও যথেষ্ট হবে না সামনের দিনে, ভবিষ্যতের চীনের জনবিন্যাস, নগরায়ন চীনের আমলাতান্ত্রিক শাসনকে সর্বদা সহ্য করবে, এমন মনে করার কোন কারণ নেই। এবং সেটা যদি জনগণ মনে না করেন, তাদেরকে একতরফা দোষারোপ করার কোন উপায় দেখি না।

মনে রাখতে হবে, এই সবগুলো দেশে যে প্রেক্ষিতে ‘সমাজতান্ত্রিক’ বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল, সেই ঊনিশ শতকীয় বাস্তবতা বা বিশশতকীয় মার্কিন নিয়ন্ত্রণ, সবকিছুরই বদল ঘটেছে। বলা যায়, এই দেশগুলোতে যে ধরনের নৃশংস শাসনের মাঝে তারা নিজেরা ছিলেন, তারই পালটা বন্দোবস্ত প্রয়োজন হয়েছিল, বিপ্লবকে, জনগণের জীবনের রুপান্তরকে রক্ষার জন্যই। তারপরও, বিশেষ করে কিউবার শাসন পদ্ধতি তো এদের সকলের মাঝে অনন্য– যথাসম্ভব আমলাতন্ত্রহীন, সৃজনশীল, উদ্ভাবনী ও একইসাথে তেজোদীপ্ত। কিউবা এমন একটা দেশ যে সামরিক বাহিনীর পেছনে সামান্য ব্যয় করেও দুনিয়ার সব চাইতে শক্তিশালী দেশটির একের পর এক সামরিক হুমকিকেও অতিক্রম করতে পেরেছে।

তবু, অতীতের বিপ্লবগুলোর এই সমস্ত অবদান স্বীকার করেও তারা যে সকল শাসনতান্ত্রিক ও দার্শনিক সঙ্কটকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়নি, সেটা উপেক্ষা করলে চলবে না। আমাদর মত নামকাওয়াস্তে গণতান্ত্রিক, মূলত দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে সমাজরুপান্তর আনতে ভবিষ্যতের কর্মসূচি নিয়ে ভাবতে গেলে রাশিয়া বা চীনের কিংবা কিউবার অনুকরণ হয়তো কাজে দেবে না। শেখ হাসিনার শাসন যতই ভয়াবহ হোক না কেন, ঊনিশ শতকের চীন বা রুশ জমিদারদের সাথে তা তুলনীয় না। বিশ্বব্যবস্থায়ও বহু বদল এসেছে, মানুষের আকাঙ্ক্ষায়ও। তারও চাইতে বড় কথা, মার্কসের দর্শনকে যদি গ্রহণীয় বলেই আমরা কেউ মনে করে থাকি, তার চিন্তার মাঝে এই একদলীয় আমলাতান্ত্রিক শাসনের বৈধতা কোথাও কি মিলবে?

কিউবার মুরগি বিষয়ে এই ছোট্ট বিষয়টা বলেই শেষ করি। প্রশ্নটার উত্থাপনই বাংলাদেশে বসে আমাদের জন্য একটা বিশেষ কারণে লজ্জার, সেটা হলো গরিব ও অদক্ষ কিউবার শাসকরা তাদের নিজের দেশের মানুষের জন্য মাথাপিছু প্রায় ২৪ কেজি মুরগির মাংস বরাদ্দ করতে পেরেছেন। বাংলাদেশের পোলট্রি বিপ্লবের বিপুল অগ্রগতি সাধন হবার পরও এই দেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু দুই কেজি মুরগি খেতে পান না। পুঁজিবাদের অপরিকল্পনা, অদক্ষতা ও মূঢ়তা আমাদের এইটুকু উন্নতি দিয়েছে। সারকথা এই যে, যে অর্থনৈতিক স্তরে আমরা আছি, সেখানে রাষ্ট্রীয় তদারকিতে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে বহুরকম পুঁজিবাদী উন্নয়ন আমাদের প্রয়োজন হবে। কিন্তু পুঁজিপতিদের মাথায় উঠতে দেবেন তো যা হচ্ছে, সেটাই অনন্তকাল হতে দেখবেন।

কিন্তু শুধু খাদ্যের সংস্থান করাটাই যথেষ্ট নয়, কেননা মানুষ কেবল রুটি-মাংসে বাঁচে না। তার মতপ্রকাশের ক্ষুধা আছে, তার অংশগ্রহণের কামনা আছে। সেটাকেও স্বীকার করতে হবে।

ফিরোজ আহমেদ

সদস্য, রাজনৈতিক পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন

#উম-৭/৫

Leave a Reply