You are currently viewing সিআরবি : তথ্য যুক্তি প্রাণ প্রকৃতি রক্ষার লড়াই।

সিআরবি : তথ্য যুক্তি প্রাণ প্রকৃতি রক্ষার লড়াই।

আকাশ কি বেচাকেনা করা যায়?

আকাশ কি বেচাকেনা করা যায়?

কিংবা ভূমি?

আমরা যদি বাতাসের নির্মল মালিক না হই  তবে তা আমরা কিভাবে বিক্রি  করব? 
আমাদের ধমনীতে বয়ে চলা রক্তস্রোতের মতই গাছের ভেতর দিয়ে বয়ে চলে প্রাণরস। আমরা এ ধরিত্রীর অংশ, এ ধরিত্রী ও আমাদের অংশ। 


সিআরবিতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি)  মাধ্যমে ৫০০শয্যার হাসপাতাল ও ১০০ সিট বিশিষ্ট  মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ এন্ড কোম্পানি লিঃ  ছয় একর জমি বরাদ্দ পেয়েছে। এ প্রকল্পের বেশকিছু লাভের মুলা বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ মানুষকে দেখিয়ে যাচ্ছে। এসকল বক্তব্য নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষের বিভিন্ন যুক্তি আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 


বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তাদের বক্তব্যে প্রকল্পের সামাজিক সুবিধা:

  • হাসপাতাল হলে রেলওয়ে কর্মচারী-কর্মকর্তা ও চট্টগ্রামের মানুষ সুবিধা পাবে।
  • কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
  • হাসপাতাল পরিচালনার ফলে অত্র  এলাকায় বেশকিছু ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি হবে। যেমন – ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, জেনারেল স্টোর, ফুড সেন্টার  ইত্যাদি। 


শুধু কি তাই?  আরো থাকবেন রোগী ও তাঁর সঙ্গী,  দর্শনার্থী, ছাত্র-ছাত্রী, ডাক্তার,  নার্স, হোটেল-রেস্তোরাঁ, এ্যম্বুল্যান্স,গাড়ি ইত্যাদি।  সব মিলিয়ে এলাকাটি হয়ে উঠবে বেশ জমজমাট। 
তবে তারা বলছেন না যে, এত এত স্থাপনা ও কয়েক হাজার মানুষের বাড়তি চাপ  সিআরবি এলাকার ধ্যানী ভাব চিরতরে ভঙ্গ করে কোলাহলময় পরিবেশ তৈরি করবে। ফলে অক্সিজেন কারখানা ধীরে ধীরে ধ্বংস হতে থাকবে। খেলাধুলা, ব্যায়াম, হাঁটা,  দৌড়ানো, মুক্ত বায়ু সেবন, বেড়ানো ও বিনোদনের জায়গা নষ্ট হবে। পরিবেশের প্রভাব  : সিআরবি’তে হাসপাতাল নির্মাণ করলে পরিবেশের মৃদু ক্ষতি হবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দাবি। তা কাটাতে “ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট”এ  “এনভায়রনমেন্টাল  ইনপেক্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান”-এ দিক নির্দেশনা দিয়েছে। যা অরেকবার জানানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি।

  • ভাঙ্গাভাঙ্গির কাজে হ্যান্ড টুলস বা সেমি মেকানিকাল যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করাযাবে না।   # ধুলা-বালি ইত্যাদি নিরসন করার জন পানি বা wind breaks ব্যবহার করতে হবে। 
  • মাটির স্তুপকে পাটের ব্যাগ বা তারপুলিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে যাতে শুষ্ক আবহাওয়ায় তা থেকে ধুলা বালি নির্গত না হয় অথবা বর্ষাকালে ধুয়ে না যায়।
  •  কদম এবং মেহগনি গাছ সমূহকে রক্ষা করতে হবে। যদি কেটে ফেলতে হয় এমন অবস্থায় একটি কাটা গাছের পরিবর্তে ক্ষতিপূরণ হিসেবে চারটি গাছ রোপন করতে হবে। 
  • ময়লা পানি (sewerage water) পরিশোধন করার জন্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করতে হবে। পরিশোধিত পানি পরিষ্কার পরিছন্নতা, ধুলাবালি প্রতিরোধ করা এবং বাগানে গাছের পরিচর্যায় ব্যবহার করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। 
  • মেডিকেল বর্জ্য পদার্থসমূহ  Bio Medical Waste Management System -এর মাধ্যমে পরিশোধনের জন্য প্রেরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ সমূহ আলাদা করার ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং তা আলাদা করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের Solid West Management System এ হস্তান্তর করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।


পরিবেশগত প্রভাব বিষয়ে এ সুপারিশ আমাদের আরো আতঙ্কিত করে। পরিবেশে “মৃদু” ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বলে তাদের দাবি। এবং তার একাংশের সমাধান মৃদু যন্ত্র ব্যবহার, পানি ছিটানো, পাটের ব্যাগ, তারপুলি দিয়ে করার কথা বলছেন। শতবর্ষী গাছ কাটা হবেনা বলে প্রচার চালালেও সুপারিশে বলছে ‘কদম’ ও ‘মেহগনি’ গাছ রক্ষার কথা। অথচ পুরো সিআরবি এলাকায় সবচেয়ে বেশি পরিমান শতবর্ষী বৃক্ষ হলো শিরীষ। এ ছাড়াও পুরো সিআরবি এলাকায় বিলুপ্ত প্রায় বেশকিছু বৃক্ষ ও গুল্মের সন্ধান পাওয়া গেছে। যার কোনো উল্লেখ মূল্যায়ন বা সুপারিশে নাই। এমনকি পুরো এলাকার তাপমাত্রা, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর প্রকল্পের প্রভাব কী হতে পারে তা উল্লেখ নেই। ফলে “এনভায়রনমেন্ট ইমপেক্ট ম্যানেজমেন্ট প্লান” এর ওপর বিশেষজ্ঞ বা চট্টগ্রামবাসী কেউ আস্থা রাখতে পারছেন না।


একযুগ আগে “নববর্ষ উদযাপন পরিষদ” সিআরবির শিরিষ তলায় বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় উৎসব আয়োজন শুরু করে, যা আজো চলমান। সে থেকে এ এলাকাটি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনের গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়ে আছে। বসন্ত উৎসব, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী সহ বিভিন্ন আয়োজন এখন নিয়মিত ব্যাপার। এখানে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়। এরপাশে বানিজ্যিক হাসপাতাল হলে এ আয়োজনগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাবে।


সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য :চট্টগ্রামকে বাসযোগ্য ও পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় সিডিএ মহাপরিকল্পনা (মাস্টার প্ল্যান)  প্রণয়ন করে। যেখানে সিআরবি এলাকাকে “স্ট্রেটেজিক ওপেন স্পেস” হিসেবে চিহ্নিত করে। মাস্টার প্ল্যানের আলোকে সিডিএ “ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান(ড্যাপ)” প্রণয়ন করে। ২০০৯ সালে যা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়। ড্যাপ-এ সিআরবি-কে “সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য” হিসেবে সংরক্ষণের কথা বলা আছে। অর্থাৎ সিআরবিকে একইসাথে অক্সিজেন কারখানা হিসেবে, পরিবেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হিসেবেও সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে। 


শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও সিআরবি:মহান মুক্তিযুদ্ধের ১০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা  শহীদ হন সিআরবি এলাকায়।

১. বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুর রব।(জিএস – চাকসু)

২.বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মনোয়ার হোসেন (ডবল এমএ)।

 ৩. বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ বিমল সিং। 

৪. বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ফখরুল আলম। 

৫. বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সিরাজুদ্দিন। 

৬. বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ নজীর আহম্মদ।

৭. বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আলী নূর।

৮. বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মহিউদ্দিন। 

৯. বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ নুরুন্নবী চৌধুরী 

১০. বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ গঙ্গারান।


তাঁদের স্মরণে প্রস্তাবিত হাসপাতাল এলাকায় একটি স্মৃতি স্তম্ভ আছে। শুধু তাই নয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুর রব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ নজির আহমদ এর কবরস্থান ও এ এলাকায় অবস্থিত। 

সংবিধান:

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ক ধারায় এই মর্মে অঙ্গীকার করেছে যে, “রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি,  বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।”
জাতীয় স্মৃতিনিদর্শন বিষয়ে ২৪ ধারা – ” বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমন্ডিত স্মৃতিনিদর্শন, বস্তু বা স্থান-সমূহকে বিকৃতি বা অপসারণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য রাষ্ট্র ব্যাবস্থা গ্রহণ করিবেন।”
প্রবল জনমত,  মাস্টার প্ল্যান ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান – এ সিআরবি সংরক্ষণের জোর সুপারিশ, মুক্তিযুদ্ধে দুজন শহীদের কবরস্থান ও শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা সবকিছু উপেক্ষা করে কিসের শক্তিতে বানিজ্যিক হাসপাতাল করতে মরিয়া কতৃপক্ষ? চট্টগ্রামবাসী জানতে চায়।

হাসাম মারুফ রুমী
সদস্য, রাজনৈতিক পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন

#উম-৭/৪

Leave a Reply