You are currently viewing আন্দোলন যেভাবে সমাজের পরিসর বাড়ায়

আন্দোলন যেভাবে সমাজের পরিসর বাড়ায়

প্রতিটি গণআন্দোলনে অদৃশ্য সব দেয়াল ভেঙে পড়ে, সমাজে মুক্ত পরিসর বাড়তে থাকে। এমনকি নতুন মুক্ত পরিসর নির্মিতও হতে থাকে, আগে যা হয়তো ছিল কল্পনারও অতীত। গণআন্দোলনের নগদ যা অর্জন, তার সঙ্গে সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে এই পাওয়াগুলোর মূল্যও কম নয়। এই বছর ‌‌’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সূচনার ৫০ বছর পূর্তি, ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে সূচনা ঘটেছিল আইয়ুব শাহির পতনের এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের সূতিকাগার এই আন্দোলনটির। বাংলাদেশের জনজীবনে গভীর ছাপ রেখে যাওয়া এই আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সমাজের নানান সব পরিসরও কীভাবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়, সে নিয়ে অল্প কিছু আলোকপাত করা যাক।

১.

গণঅন্দোলনের সবার আগে যে দেয়ালটা টুটাফাটা হতে শুরু করে, সেটা ভয়ের দেয়াল। আর যেকোনো স্বৈরতন্ত্রের মতো আইয়ুবের শাসনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল ভীতির একটা পরিবেশ। এনএসএফের কথা আমরা সকলে জানি, জানি খোকা-পাচপাত্তুরের কথা। দুই পাকিস্তানের মাঝে বৈষম্যের কথা তুলে ধরার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু মাহমুদকে ভয়াবহ নিপীড়ন করে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগে এক রকম বাধ্য করে সংগঠনটি। বিশ্ববিদ্যালয়কে আতঙ্কের চাদরে রুদ্ধ করে রাখা এই এনএসএফ নিমেষে উড়ে গেল গণজোয়ারে। এটা ঠিক যে, জনতা নিপীড়নকে উপেক্ষা করতে শিখতে থাকার সঙ্গে সঙ্গেই শাসক নিপীড়ন বন্ধ করে দেয় না, বরং কখনো কখনো নিপীড়নের মাত্রাটা বাড়িয়েও দেয়। কিন্তু আতঙ্কের দেয়ালের ফাঁকফোকর গলে ক্রমে বেশি মানুষ বেরিয়ে আসতে থাকে, একসময় দেয়ালটা ধসে পড়ে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে এই আতঙ্ককে জয় করা মানুষের ঢলের ছবি এঁকেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে। সে এমন একটা ছবি, যার বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের একটি বর্ণনাকে নিখুঁত মনে হয় : এসেছে সে এক দিন, লক্ষ পরানে শঙ্কা না জানে, না রাখে কাহারও ঋণ, জীবন মৃত্যু, পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন।

২.

গণআন্দোলনে দ্বিতীয় দেয়ালটি ভেঙে পড়ে প্রায়ই, সেটা পুরুষতন্ত্রের। আধুনিক স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে পুরুষের একক শক্তির চেষ্টা যে অর্থহীন এবং অক্ষম, সত্যিকারের গণআন্দোলনগুলোতে সেটা প্রায়ই দৃশ্যমান হতে থাকে। কিন্তু এটা শুধু সংগ্রামের বিজয়ী হওয়ার কৌশলগত ভাবনাই নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের রুদ্ধতার পাশাপাশি সমাজের মাঝে পুরুষতন্ত্রের নিগড়েও নারীরা যেভাবে বন্দি থাকে, যেভাবে প্রায়ই এটাকে সহজাত বলে, স্বাভাবিক বলে মেনেও নেয়া হয়, তাই গণআন্দোলনের সময়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে। এর সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ মিলবে তেভাগা আন্দোলনে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রযন্ত্রের তীব্র হামলায় পুরুষ কর্মীরা যখন ময়দান ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, নারীদের রুখে ওঠা তখন তেভাগা আন্দোলনকে নতুন শক্তি দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনটি অব্যাহত থাকার কারণে রীতিমতো নারী বাহিনী গড়ে উঠেছিল এই সময়ে, আন্দোলনের এলাকাগুলোতে প্রজন্মান্তরে একটা দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক ছাপও ফেলেছে তা।

অবশ্য লড়াইয়ের ময়দানে নারীর উপস্থিতিকে মেনে নিয়েছে বলেই পুরুষতন্ত্র তাকে স্বীকার করে নিয়েছে, এমনটা বলা যাবে না পুরোপুরি। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, আন্দোলনের অব্যবহিত পরপরই যেটুকু পরিসর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, তা আবার কেড়ে নেওয়ার আয়োজন। কিন্তু এই আয়োজনটা কখনোই পুরোপুরি সফল হয় না, কিন্তু কতখানি সফল বা ব্যর্থ হবে, তাও নির্ভর করে সমাজের বাস্তব অগ্রগতির ওপর, নির্ভর করে সমাজের চাহিদারও ওপর। তেভাগা আন্দোলন সমাজকে গতিশীল করেছিল, সত্যি। বহুক্ষেত্রে জড়তা ভেঙে দিয়েছিল, এটাও সত্যি। কিন্তু কৃষিভিত্তিক একটা সমাজে নারীর প্রকাশ্য উপস্থিতির চাহিদা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষমতার মাত্র একটা পর্যায় পর্যন্ত সীমিতই থাকে। একই ঘটনা ঘটেছিল ফরাসি বিপ্লবেও, বিপ্লবের সবচেয়ে লড়াকু আপসহীন অংশটি নারীরা হওয়া সত্ত্বেও যথাদ্রুত তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়ারই চেষ্টা চলল। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সমীকরণে ফরাসি নারীদের, কিংবা মোটা দাগে ইউরোপীয় নারীদেরও বিজয় সূচিত হওয়া শুরু হলো কারখানা শ্রমে নারীদের বিপুল অংশগ্রহণের সূচনা ঘটার পর থেকে।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বহু আন্দোলনে নারীদের প্রাধান্য ও অগ্রগণ্যতা ছিল, অন্তত দেশের প্রধান তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগরে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনে তো তা ছিলই। অংশগ্রহণের মাত্রা অনুযায়ী তা দেশের জনজীবনে কমবেশি ছাপও ফেলেছে। কিন্তু অন্তত বিস্তারের দিক থেকে সেগুলো ছিল এক একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। দেশজুড়ে কোনো একটা সাধারণ দাবিতে আন্দোলন আমরা দেখেছি কোটা সংস্কারের আন্দোলনে। এবং আনন্দের বিষয়, সেখানে নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বিশাল। শুধু তাই নয়, সরকারি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও পুলিশের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে নারীদের ভূমিকা শুধু রক্ষকের না, যেটা আমরা শহীদ মিনারে দেখেছি, বরং আন্দোলন ততবার নির্মূল হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে যতবার নারীরা দলে দলে নেমে এসেছেন ছাত্রাবাসগুলো থেকে। এই দৃশ্য আমাদের পূর্বপরিচিতও। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যতবার নারী শিক্ষার্থীদের ঢল নেমেছে, ততবার প্রশাসন বলি, কর্তৃপক্ষ বলি, রাষ্ট্র বলি—পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ফুলবাড়ীর উন্মুক্ত কয়লা খনিবিরোধী আন্দোলনে আমিন তরিকুল সালেহীন গুলিতে নিহত হওয়ার পর পুরুষরা যখন পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন, বাড়ি বাড়ি থেকে নেমে এসেছে নারীদের ঢল। তাদের প্রবলতা, প্রচণ্ডতা এবং ভয়হীনতার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারেনি, মানুষের জয় হয়েছে।

আরো অনেক কিছুর পাশাপাশি নারীদের এই সংশ্লিষ্টতা সমাজের ভেতর আন্দোলের প্রতি সমর্থন, তার যৌক্তিকতার স্বীকৃতি এবং গভীরতার ব্যপ্তির নির্দেশক। একদিকে তা এমন একটা নৈতিক ও আত্মিক শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে—এমনকি পুরুষতান্ত্রিক কিছু মূল্যবোধকেও আন্দোলনের পক্ষে নিয়ে আসে নারীর ওপর হামলার ঘটনা, কিংবা স্রেফ নারীদের ভূমিকা গ্রহণই।

একটা তো এমনি পুরুষতন্ত্রের দেয়াল, যা আটকে রাখার চেষ্টা করে। এর বাইরে আরো একটা দেয়াল আছে, সেটা অচেনার। রাজধানীসহ প্রধান নগরীগুলোতে নারীদের পেশাজীবী ও শিক্ষার্থী হিসেবে উপস্থিতি কম নয়। বিশেষ করে বলা যায়, পোশাক শিল্পে লাখ লাখ নারীর উপস্থিতির বদৌলতে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বদল ঘটার কথা ছিল, তার ভগ্নাংশই এখানে সম্পন্ন হয়েছে, যদিও একদম ঘটেনি তাও বলা যাবে না। আধুনিক শিল্পজগতে আমরা যেন ঢুকে পড়েছি সামন্তসুলভ মূল্যবোধগুলো নিয়ে, ফলে নতুন খুব ধীরে স্থান করে নিচ্ছে, পুরোনো যথাসম্ভব তার জায়গা আঁকড়ে ধরে থাকছে। অবজ্ঞা, দূরত্ব আর বিচ্ছিন্নতা আমাদের সমাজে নারী আর পুরুষদের যেভাবে পৃথক করে রাখে, মিছিলগুলোতে সেটা ক্ষয়ে যেতে থাকে। হাজারটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের চাইতে হয়তো একটা অজস্র নারী ও পুরুষের সম্মিলিত সমাবেশের কর্মসূচি তাই অনেক বেশি শক্তিশালী নারীর উপস্থিতি মেনে নেওয়ার সহিষ্ণুতা অর্জন শেখাতে। শিক্ষার পার্থক্য, সমাজের স্তরবিণ্যাসের পার্থক্য, শহর-মফস্বল-গ্রামের পার্থক্যসহ আরো বহু ভেদাভেদের প্রাবল্য যে তীব্র বিভাজন সৃষ্টি করেছে, সংগ্রামের প্রবল তাপে ও চাপে তা ম্রিয়মাণ হতে থাকে। কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মিছিলগুলোতে যেমন আমরা দেখেছি আমাদের সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করা সকল রকম পোশাকের একটা জীবন্ত সমাবেশ—শার্ট-প্যান্ট, পাজামা, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ কি হিজাব। পোশাককে পরিচয় না ভেবে কর্মসূচিটাকে প্রধান ভেবে নেওয়ার মাঝে আছে সেই বৈচিত্র্যকে ধারণ করার ক্ষমতার বৃদ্ধি। নারীদের পোশাক নিয়ে কিছুকাল আগে বিদ্রুপ করা ছেলেটাই হয়তো তার অগ্রগণ্যতা মেনে নিচ্ছে।

মেনে নিচ্ছে, নাকি সহ্য করছে? সহ্য করলেও ক্ষতি কী? সেটাও কিন্তু সমাজেরই একটা বাস্তব অগ্রগতি। কারণ বহু বিভাজন আছে, তা সহজে যাওয়ার নয়। কিন্তু এই যে সহ্য করতে বাধ্য হওয়া, তা নিয়ে সিমন দা ব্যুভয়া দারুণ একটা কথা বলেছিলেন ফরাসি নারীদের অভিজ্ঞতা থেকে—মন থেকে মেনে না নিয়েও তো একজন সুনিশ্চিত দক্ষিণী শ্বেতশ্রেষ্ঠত্ববাদী আর নিগ্রো বলে কাউকে গালি দিতে পারছে না! এই মেনে নিতে অভ্যস্ত হওয়াটাতে আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এবং আশাই করা যায়, আন্দোলনের সফল সমাপ্তি ঘটলেও বাংলাদেশের সমাজে নারীদের আবার সেই দেয়ালে বন্দি হওয়ার ঘটনা হুবহু পুনরাবৃত্তি হবে না, কেননা বাস্তব সমাজের চাহিদা এবং নারীদের অগ্রগতি এই দেয়ালকে ক্রমশ ভাঙছেই।

কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নারীর উপস্থিতির গুণতম রূপান্তর কেবল সম্ভব হবে পোশাক শিল্পে সংগঠন করার গণতান্ত্রিক অধিকারটি অর্জন করা গেলে। বিপুল পরিমাণ কর্মজীবী নারীর সংগঠিত হওয়া বাংলাদেশে ভবিষ্যতে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে সবলে বদলে দেবে, যেমন দিয়েছে আরো বহু দেশে। আপাতত এখানে তা ঠেকে আছে মালিকদের সস্তা মজুরিতে তাদের কাজ করিয়ে দেওয়ার লোভ, শ্রম অঞ্চলে শ্রম পুলিশ আর প্রবল নিপীড়ন।

৩.

সত্যিকারের গণআন্দোলনে সর্বশেষ দেয়ালটি ভেঙে পড়ে, সেটা অহমিকা ও শ্রেষ্ঠত্ববাদের। দুটি প্রবল অনুভূতি : মুসলমান এবং বাঙালি এই দুই শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি আমাদের সমাজের গণআন্দোলনহীন গত কয়েক দশকে ক্রমশ শক্তপোক্ত আকারে জেঁকে বসেছে। অন্য কাউকে সহ্য করার, নিজের সমান ভাবার, পিছিয়ে থাকলে তার জন্য পরিসর করে দেওয়ার চিন্তা এই সংকীর্ণ শ্রেষ্ঠত্বের ধারণায় কল্পনাতীত ঠেকে প্রায়ই। ফুলবাড়ীর উন্মুক্ত কয়লা খনির বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে যেমন দেখা গিয়েছিল আদিবাসী সাঁওতাল ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মরণপণ লড়াই, সেটা কিন্তু বেশ বিরল। কিন্তু জনগণের মাঝে এই সব শ্রেষ্ঠত্ববাদী চিন্তাও প্রবল নাড়া খেতে থাকে তাকে কোন গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হলে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মতোই, জাতিগত বিষয়েও দেখা যায়, বহু ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি ঘটে; বহুক্ষেত্রে অন্তত মেনে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে হয় বাধ্য হয়ে। কিন্তু সামগ্রিক একটা আন্দোলন মিত্র বৃদ্ধির চেষ্টা করে, শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করে; আর সেই সব চেষ্টার মধ্য দিয়ে ক্রমাগত নিজেকে পরিশোধন আর উত্তরণের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এই যে ‘কোটার সংস্কার চাই’ না ‘কোটার অবসান চাই’, এই বিতর্কগুলো আমাদের সমাজের জন্য শেষ পর্যন্ত ইতিবাচকই হয়েছে। ‘আমি’ এবং ‘অপরে’ বিভক্ত সমাজে অপরের স্বার্থও যে গুরুত্বপূর্ণ, এবং তার স্বার্থে আঘাত করে গণআন্দোলন ব্যপ্তি হারাবে, সেই উপলব্ধির প্রকাশ আমরা ক্রমশ আরো শক্তিশালীভাবে উপস্থিত দেখলাম কোটা সংস্কার আন্দোলনেই। এটা আরো ইতিবাচক এই কারণেও যে, যারা রাজনৈতিক কারণে চাকরির সংখ্যার বড় অংশই মুক্তিযুদ্ধের নামে কোটা সুবিধার মাধ্যমে নিজেদের জন্য রক্ষায় মরিয়া, তারাও শক্তিবৃদ্ধির জন্য আদিবাসী কোটাকে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করছে, (আবার বিসর্জন দেওয়ার সময়ে সেটাই সবার আগে বিসর্জনের কথা বলছে)। অর্থাৎ আদিবাসী কোটা যে প্রয়োজন এবং তাকে যে রাখতে হবে, দুই তরফেই রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে তার ব্যাখ্যা হাজির করেছে। সিমন দ্য ব্যুভয়ার কথামতোই, অন্তরে বাঙালি কিংবা মুসলিম শ্রেষ্ঠত্ববাদী মনোভাব পুষে রেখেও মুখে এই উদার মনোবৃত্তির প্রকাশ শঠতাপূর্ণ হলেও এই স্বীকৃতি রাজনৈতিক চর্চার অংশ হয়ে যাবে, সেটাই অগ্রগতি। চর্চাটা ধীরে ধীরে অভ্যাসে, স্বাভাবিকত্বেও পরিণত হয়ে যাবে।

বাস্তবে এমন একটি উদাহরণ আমাদের ভূখণ্ডেই আছে। প্রয়াত জননেতা মহিউদ্দিন আহমেদ, বাকশাল মহিউদ্দিন নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। ’৪৭-এর দেশভাগের সময়ে তিনি মুসলিম লীগের অন্যতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজ তরুণ ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও দেশে অবশিষ্ট হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি তার আচরণের কারণে বরিশালের জেলা প্রশাসক তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হন। গ্রেপ্তার দশাতেই তিনি অসাম্প্রদায়িকায় হাতেখড়ি নেন, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন তাকে আজীবনের জন্য অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। শুধু ব্যক্তি মহিউদ্দিন আহমেদ নন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি বিপুল তরুণতর জনগোষ্ঠীর জন্যই এই অভিজ্ঞতা প্রযোজ্য। বাস্তব সংগ্রামের অভিজ্ঞতা তাদের মুসলিম লীগের উগ্র সমর্থক থেকে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদীতে পরিণত করেছিল—যদিও জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে তাদের নিতে পেরেছিল, তা সর্বদা বলা যাবে না, কিন্তু সে রকম দৃষ্টান্তও প্রচুর রয়েছে।

৪.

গণআন্দোলনে অদৃশ্য আরেকটা দেয়াল ভেঙে পড়ে, সেটা আমিত্বের। রাজনীতিবিমুখ, ‘কাগজ পড়ি না’, বিরক্ত কিংবা আত্মতৃপ্ত সময়কে কাঁপিয়ে দেয়। তরুণরা সময়ের সংকট নিয়ে, তার সমাধান নিয়ে ভাবতে বসেন। অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি বাংলাদেশে অর্থনীতিবিদ হিসেবে যারা, স্মরণীয়, যারা স্মরণীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে, তাদের প্রায় প্রত্যেকের পেছনে তাগিদ হিসেবে কাজ করেছে সমাজের এই সব আলোড়ন। ’৬৯ কিংবা ’৭১ তাদের অনেককে এত তীব্রভাবে তাড়িত করেছে যে নিজের সমাজ নিয়ে, ইতিহাস নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে তারা কাজ করেছেন, বোঝার চেষ্টা করেছেন। আন্দোলনের ঝাঁকি সাধারণভাবেই সমাজে প্রশ্নের জন্ম দেয়, সব স্তরেই সংকটগুলো নিয়ে আলোচনা আর সমাধানের বাসনা দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞরা সেই সাধারণ আগ্রহ আর আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ ঘটান। আরো এগিয়ে বলা যায়, এক একটা সংকট নতুন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি আর সমাজবিজ্ঞানের জন্ম দেয়, নতুন মৌলিক বিশেষজ্ঞরও। মুখস্ত বিদ্যা দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস থেকে শ্রমিক অঞ্চল পর্যন্ত কীভাবে উপস্থিত আছে, তার ব্যাখ্যা করা যাবে না। কিংবা যদি পুরোনো কোনো তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়ও, সেটাও আয়ত্ত করা দরকার হাসপাতাল কেন আহত শিক্ষার্থীকে চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে, গণমাধ্যমের সঙ্গে বাংলাদেশের এই শাসকদের দ্বন্দ্ব আর বিরোধের সম্পর্কটা কী।

অন্তত যে হিমবাহের চূড়া আমরা দেখতে পাচ্ছি কোটা সংস্কার আন্দোলনে, তা তো বাংলাদেশের বিপুল বেকারত্বের জন্ম দেওয়া ‘উন্নয়ন’ কর্মকাণ্ডের ফল, তার সমাধান কী, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত বিকল্প কী, কীভাবে দেশীয় অর্থনীতির বিকাশ আমরা ঘটাতে পারি, কীভাবে পারি শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে, বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম শিল্পপণ্য বানাবার মতো শিল্পনীতি তৈরি করতে। তরুণদের মাঝে সেই সব বিষয়েই প্রবল আগ্রহ জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা আছে এই বেকারত্বের চাপের, কেননা সবকালেই একদল যেমন সংকটে কেবল নিজেদের আত্মরক্ষার চেষ্টাতে মগ্ন হয়, একটা বড় অংশই নতুন করে সমাধান খুঁজতে বসে। সেই পথেই নতুন রাজনীতির চিন্তা রাজনৈতিক দল ও পরিবর্তনের সূচনা ঘটে।

৫.

কোটা সংস্কার আন্দোলনের দুর্বলতা নিয়েও কিছু কথা বলা যাক। এর কার্যপরিষদ গঠনে নারীদের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়েনি। নারীদের উপস্থিতির প্রাবল্য ও সুবিধা কার্যক্ষেত্রে টের পাওয়া গেলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরে তাদের অংশগ্রহনকে যথেষ্টমাত্রায় মেনে নেয়া হয়নি বলেই মনে হতে পারে। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই কার্যপরিষদ গড়ে ওঠে থাকলে বলাই যায়, নারীদের বাস্তব অগ্রগতিকে তা প্রতিফলিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এবং এর অন্য একটি দুর্বলতার দিক হলো কেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব, তারা যখন আক্রমণের শিকার হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে—গণআন্দোলনে সেটা স্বাভাবিকও—আন্দোলনের কেন্দ্র বেশ খানিকটা ভেঙে পড়েছে। বরং এমন আন্দোলনের বেলায় বিকেন্দ্রীকৃত নেতৃত্ব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত স্বাধীন নেতৃত্ব বেশি সুবিধাজনক। তার ছোট একটি নমুনা দেখা গিয়েছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর মূল্য সংযোজন কর চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনে। এই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেতৃত্বের যথাসম্ভব বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এমন আক্রমণ ও দমনপীড়নকে একদিকে কঠিন করে তুলত, অন্যদিকে আরো প্রতিনিধিত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক হতো। দমনপীড়নে একটা অস্থিরতা বা বিমূঢ়তার ধাক্কায় অবশ না হয়ে গিয়ে শাখাগুলো তাদের ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হতো। সংগত কারণেই নেতৃত্বেও বৈচিত্র্য আসত, নারী, আদিবাসী এবং সম্প্রদায়গত ভারসাম্য প্রতিফলিত হতে পারতো।

শেষত এটা স্বীকার করতেই হবে, কোটা সংস্কার আন্দোলন আদিবাসী কোটার পক্ষে ভূমিকা নিলেও, তাদের সততায় আমাদের অনাস্থা না থাকলেও, এই ক্ষেত্রে তারা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পুরোপুরি আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়নি। আন্দোলনের সূচনাতে নানামুখী টানাপড়েন অচিরেই একটা ইতিবাচক জায়গায় এলেও তত দিনে অবিশ্বাস কারো কারো মাঝে গাঢ় হয়েছে। এর পেছনে দীর্ঘ বৈষম্যের অভিজ্ঞতাও কাজ করেছে। বহু বন্ধুর কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই জানি যে, সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়া নিয়ে আদিবাসীদের বিদ্রুপের শিকার হতে হয়। অথচ এই কোটা এমন বেশি কিছু নয় শুধু, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের জন্য যে বিরাট সংরক্ষণের ঘোষণা এসেছে, তা বাস্তবায়িত হওয়া শুরু হলে মেধাক্রমের জায়গাতে সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলেই তার জন্য বঞ্চিত হবেন, এই ভবিষ্যৎ বাস্তবতাটির চাইতে তাই বর্তমান ন্যূনতম বাস্তব সুবিধাটি থেকে বঞ্চিত হবার শঙ্কাটি সংগত কারণেই বেশি কাজ করেছে। আন্দোলনকারীদেরই দায়িত্ব ছিল তাদের কার্যপরিষদে আদিবাসী প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা, তাদের মতামত শোনা এবং তাদের মতামতেরও প্রতিফলন ঘটানো। সেই সময় ও সুযোগ এখনো নিশ্চয়ই ফুরিয়ে যায়নি।

কোনো সমাজই বিশুদ্ধ নয়, কোনো ব্যক্তিও নন। গণআন্দোলনগুলোই সমাজের সবচে ভালো পরিশ্রুত করার পদ্ধতি, পাতনযন্ত্র। বিভেদ-বিচ্ছেদ-অসহিষ্ণুতা-আতঙ্ক-অচেনার যে দেয়ালগুলো নাগরিকদের ভেদ করে রাখে বলে বৈষম্য আর অবিচার পাকাপোক্ত আসন গাড়ে, গণআন্দোলনগুলো তার সবচেয়ে বড় শোধক। এই কারণেই আমাদের চারদিকে গত কয়েক দশকে যে সমাজ কাঠামো গড়ে উঠেছে, যে আন্দোলনগুলোও নানান মাত্রায় নানান সময়ে দেখা গিয়েছে, তা আরো বেশি মনোযোগ আর কৌতূহল দাবি করে। অনুকূল পরিবেশ আর সমর্থন পেলে এর মধ্য দিয়েই উঠে আসে সমাজের নতুন নেতৃত্বও।

ফিরোজ আহমেদ

সদস্য, রাজনৈতিক পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন

#উম-৭/১

Leave a Reply