You are currently viewing বাজেট বক্তৃতার মায়াকান্না কি  কৃষককে মামলা থেকে বাঁচাবে?

বাজেট বক্তৃতার মায়াকান্না কি কৃষককে মামলা থেকে বাঁচাবে?

করোনাকালীন এই দুঃসময়ের বাজেটেও কৃষি খাতের জন্য নেই বিশেষ মনোযোগ। গতানুগতিক হারেই এবারেও বরাদ্দ পেয়েছে কৃষিখাত। প্রস্তাবিত বিরাট অংকের বাজেটের আকার গত অর্থবছরের তুলনায় যে পরিমাণ বেড়েছে, সেই আনুপাতিক হারে কৃষি খাতে বরাদ্দ ও ভর্তুকি বাড়েনি। গত অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে কৃষিতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৭,০২৩ কোটি টাকা, যা ছিল মূল বাজেটের ৫.৩৯শতাংশ। এবছর বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ৩১,৯৯৫ কোটি টাকা, যা কিনা মূল বাজেটের ৫.৩০ শতাংশ। অংকের কথাতেই প্রমানিত, শতকরা হারে কৃষি খাতের জন্য সরকারের কোন বাড়তি মনোযোগ নেই। সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, গেল ৫টি বাজেটেই উপেক্ষিত থেকেছে কৃষিখাত। বাজেটে বরাদ্দের অংক বাড়লেও আদতে শতকরা হারে কমেছে কৃষি খাতের বরাদ্দ।

অথচ বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিশেষ বাজেট প্রণোদনা দেয়া উচিত। কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষককে নগদ সহায়তা দেয়া উচিত ছিল। করোনা মহামারীতে পরিবহণ সংকটে ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হয়েছেন কৃষক। এর ওপর ঘুর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ দেশে উপকূলীয় জেলার কৃষকরা। এসব  বিবেচনায় কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি তা নগদ হিসেবে দেয়া উচিত কৃষকের হাতে।

আমরা দেখতে চাই কৃষিতে যা বরাদ্দ হবে, তার দূর্নীতি হবেনা, অপচয় হবেনা। দক্ষভাবে তহবিল ব্যবস্থাপনা করতে পারা এবং সক্ষমতা বাড়িয়ে প্রকৃত কৃষকদের মাঝে এই সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে। কৃষি বিপণনে বিনিয়োগে ও কৃষি পন্যের পরিবহনে বিশেষ বিনিয়োগ দরকার। তৈরি পোশাক শিল্পের মতোই শক্তিশালী আর্থিক প্রণোদনা, সল্প সুদের সহজ শর্তে ঋণ যেন প্রকৃত কৃষকরা গ্রহণ করতে পারে। 

দুই দশক আগে ২০০০ সালেও কৃষিতে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ৬০ শতাংশ ছিল। এই বিশ বছরে কৃষি শ্রমিকের পরিমাণ কমতে কমতে এখন ৪০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ফলে কৃষি মজুরের সংকট যেমন বেড়েছে, তেমনি মূল্যও অনেক বেড়েছে। দেশের অধিকাংশ কৃষকের পক্ষে বাড়তি শ্রমমূল্যে চাষাবাদ করা অলাভজনক হয়ে পড়ছে। ফলে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই। ফলে কৃষি চাষাবাদ, ফসল উত্তোলন ও প্রসেস করার যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কৃষককে কৃষি ভর্তুকির আওতায় সুযোগ প্রদানের পাশাপাশি সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি কৃষিঋণেরও ব্যবস্থা করা জরুরি। 

বাংলাদেশের কৃষক হাজারো প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে চালু রেখেছে। ফলে শস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের ১৮ কোটি মানুষের অন্নের যোগান দিচ্ছে এই কৃষকরা। অথচ আমরা দেখছি মাথাপিছু ৩০,০০০ টাকা ঋণের দায়ে ১,৬৮,১৬৫ জন কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো থেকে কৃষকদের নেয়া ঋণের পরিমাণ সুদে আসলে ৫১৫ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকা। ইতোমধ্যে ১১ হাজার ৭৭২ জন কৃষকের বিরুদ্ধে টাকা শোধ করতে না পারায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ সমস্ত কৃষকেরা আজ গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

প্রান্তিক বর্গাচাষী যারা অন্যের জমি নিয়ে চাষ করে তারাই এই মামলার আসামী। এদের নিজস্ব কোনো জমি নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছেনা। ঋণগ্রস্ত কৃষকের অনেকেই ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়েছে যা সুদে আসলে এখন দ্বিগুণ বা তার বেশি। লক্ষাধিক কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ফলে কৃষকদের স্বাভাবিক কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একই সাথে এই গরীব ভুক্তভোগী কৃষকরা মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। 

বিপুল জনসংখ্যা এবং সীমিত জমির বাংলাদেশে খাদ্যের যোগান দেবার প্রয়োজন পূরণে কৃষিতে দিতে হবে বিশেষ মনোযোগ। আমূল ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে খোদ কৃষকের হাতে জমি দিতে হবে এবং তাদের সমবায় গড়ে তোলার মাধ্যমে নিজেদের পণ্য বাজারজাত করা ও ব্যবহারের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। 

কৃষি ও কৃষকের এই সংকট সমাধানে আশু করনীয়ঃ 
১। অবিলম্বে কৃষি ঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাতিল করতে হবে।
২। সরকারিভাবে ধান, চাল, গম ও পাট ক্রয় করার ক্ষেত্রে সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে কিনতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে কৃষকদের তালিকার ভিত্তিতে কৃষকদের মাথাপিছু নির্দিষ্ট হারে খাদ্য ক্রয় করতে হবে।
৩। আমুল ভূমি ও ভূমি সংস্কার করে কৃষকদের হাতে জমি হস্তান্তর করতে হবে।
৪। লুটপাটের কৃষি ভর্তুকি বন্ধ করে বিনা সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে।
৫। খাস জমি ও অন্যায় ভাবে দখলকৃত জমি ভূমিহীন  ও কৃষি মজুদের মধ্যে বিতরণ এবং সমবায়ের মাধ্যমে চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৬। গ্রামীন মজুরদের সারা বছর কাজ ও কৃষি উৎপাদনে নিয়জিত নারী-পুরুষের সমান মজুরি দিতে হবে।
৭। রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

দেওয়ান আব্দুর রশীদ নিলু,
আহ্বায়ক,বাংলাদেশ কৃষক মজুর সংহতি,
সদস্য, রাজনৈতিক পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন।


#জ/উম-৬/৪

Leave a Reply