You are currently viewing সোহরাওয়ার্দী উদ্যানঃ প্রাণ-প্রকৃতি খেকো ‘উন্নয়নের’ খপ্পরে
রাতের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছবিঃ ফারিয়া রহমান বৃষ্টি

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানঃ প্রাণ-প্রকৃতি খেকো ‘উন্নয়নের’ খপ্পরে

ঢাকার বেশিরভাগ উদ্যান অকহতব্য। সম্ভবত এদের মাঝে সব চাইতে ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হয় রমনা উদ্যান (আর বোটানিক্যাল গার্ডেন)। অথচ কাছাকাছি থাকা সোহরাওয়ার্দী ও ওসমানী উদ্যান মর্মান্তিক দশায় আছে। আনুষ্ঠানিক উদ্যান না হলেও হ্রদের পাশের জায়গাগুলো কিছুটা ভালো। ছোটবেলায় ধানমন্ডি লেকের পাশের গাছপালার সারির মাঝে দুই ভাই বিস্তর হেঁটেছি, এখনও কদাচিৎ সেখানে হাঁটার সুযোগ পেলে ভালো লাগে। পানির সাথে সম্পর্কটাই ওখানকার শান্তিময় পরিবেশটুকুর জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে রমনার আনন্দটুকু হলো ওর বিচিত্র গাছপালা– এত অল্প পরিসরে এত বিপুল বৃক্ষরাজি খুব কমই মিলবে অন্য কোথাও।

রমনা তুলনামূলক ভালো দশায় আছে, কারণ উদ্যানটি মূলত ঢাকা শহরের যারা ক্ষমতাবান, মন্ত্রীপাড়া ও আশেপাশে যারা থাকেন, তাদের ব্যবহার্য। আমলা-ব্যবসায়ী এবং উচ্চকূলের আনাগোণার কারণে গাছগুলো নিয়মিত পরিচর্যা পায়। এর দেখাশোনার জন্য মালী, রক্ষী ও অন্যান্য কর্মচারীর সংখ্যা পর্যাপ্ত। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী আর কিছু ভাসমান মানুষজনের আনাগোণা। মধ্যবিত্তের সাথে এর সামান্য সম্পর্কটুকু ওই রমনা কালী মন্দির, মুসা খাঁর মসজিদ ইত্যাদির কারণে। ওসমানী উদ্যান প্রায় পুরোটাই ভাসমান মানুষজন আর শ্রমিকদের বিশ্রামের জায়গা ছিল। বহুদিন সেখানে আসলে যাওয়াও হয়নি, শুনেছি তার একটা বড় অংশ ইতিমধ্যেই বেদখলে চলে গেছে, পত্রিকায় দেখেছি সেখানে গড়ে উঠেছে নানান স্থাপনা।

একটা নগরে নাগরিকদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা না থাকলে কী হতে পারে, সেটা সোহরাওয়ার্দী আর ওসমানীর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ওসমানী উদ্যানকে একবার পুরোটা সাফ করে সেখানে ন্যাম সম্মেলনের জন্য ভবন বানাবার উদ্যোগ নেয়া হয়, আওয়ামী লিগের ১৯৯৬-২০০১ আমলে।

করোনায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
ছবিঃ সুমন মোড়ল

মনে আছে উমর ভাই সেটার প্রতিবাদে একটা লেখা লিখেছিলেন, ‘দি বেলস টোল ফর দি ট্রিজ’ বা এই জাতীয় একটা কিছু নাম ছিল লেখাটার। ঢাকা কুরিয়ার পত্রিকায় কি? এরপর অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে ওসমানী উদ্যানের ১১ হাজার বৃক্ষ রক্ষার জন্য একটা আন্দোলন গড়ে ওঠে। মনে আছে, জোনায়েদ সাকি ভাই এর সাথে আজিজ মার্কেটে বসে এইটার পোস্টার বানাবার কথা। মূল ছবিটা নেয়া হয়েছিল বাসায় থাকা মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার বৃক্ষ সংখ্যা থেকে, মনে হয়। ছবিটা ছিল এমন, একটা মানুষ-রূপী বৃক্ষ, তার গলায় কুঠার চালানো হয়েছে। একটা গাছকে মানবিক রূপ দিয়ে তার আর্তনাদকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। পত্রিকার সাদাকালো সেই স্কেচটাকে স্ক্যান করে কম্পিউটারে সফটওয়ার ব্যবহার করে সবুজ রঙে আরও জীবন্ত করতে সাহায্য করেছিলেন কোন শিল্পী, তা মনে নেই এখন। সাকি ভাই হয়তো বলতে পারবেন, তার স্মরণশক্তি অনন্য। সম্ভবত, ওসমানী উদ্যানের এই বৃক্ষ রক্ষা আন্দোলনটি ছিল রাজনৈতিক-সামাজি-সংস্কৃতিক সকল ধরনের সংগঠনের একটা যৌথ আন্দোলনের প্রথম দিককার সফল উদাহরণ। দীর্ঘদিন লাগাতার কর্মসূচি পালনের পর সরকার সেখান থেকে পিছু হঁটতে বাধ্য হয়। পোস্টারটা কি কারও সংগ্রহে আছে আর? এই সব ইতিহাস সংরক্ষণ করা হয়নি।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানও বহুবার বহু রকম আক্রমণের শিকার হয়েছে। অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়ে ঢাকা ক্লাবের এক পরিচালক, যিনি ছিলেন বিজ্ঞাপন ব্যবসা জগতেরও একজন মহারথী, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটা বড় অংশ দখল করে ঢাকা ক্লাবের জন্য গলফ মাঠের বন্দোবস্ত করতে উঠে পড়ে লাগলেন। পত্রিকায় সেই সংবাদ পড়ে আশঙ্কিত হয়েছিলাম। দ্রুতই নাগরিকরা প্রতিবাদ জানানোতে সেই সেনাশাসিত সময়েও ভদ্রমহিলা তার পরিকল্পনা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হন। এদের মনোভাবটা বোঝা যায়। আসলে প্রায় একটা ধূসর এবং প্রায় নিজের শক্তিতে টিকে যাওয়া, গরিব লোকজনে ভর্তি একটা উদ্যানের চাইতে প্রবেশ-নিয়ন্ত্রিত একটা সবুজ ঝলমলে গলফ মাঠের কল্পনা অনেক আকর্ষণীয় এবং উপযোগী বলেই মনে হবার কথা এমন অভিজাত চোখে। এই নগরের মানুষদের যে আরেকটু শ্বাসপ্রশ্বাসের সুবিধার দরকার আছে, দরকার আছে মাঝে মধ্যে বেড়াতে যাবার একটা জায়গার– এমনকি এই ভর দুপুরেও যে মানুষগুলো ওইখানে ঘুমুচ্ছে, কিংবা বিশ্রাম নিচ্ছে, তাদের কর্মক্লান্ত জীবনের এইটকু যে বহু গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, এইটুকু সহৃদয় ভাবনা তাদের কাছ থেকে আশা করাটা কঠিন।

কিন্তু সোহরাওয়ার্দী আর ওসমানী ধূসর কেন? শীতকালে এই তিনটা উদ্যানের পাতার তুলনা করলেই দেখবেন, পানির বাড়তি উপস্থিতি রমনাকে কতটা আকর্ষণী আর ওসমানীকে কতটা নিষ্প্রভ ধূসর বানিয়ে রাখে। ওসমানী আর সোহরাওয়ার্দীর বৃক্ষ পরিকল্পনাতেও রয়েছে মারাত্মক ঘাটতি। কিন্তু তাই বলে কি এদের গুরুত্ব একবিন্দু কম? বা তাদের বিকশিত হবার, আরও প্রাণপ্রাচুর্যে পল্লবিত হবার কোন সম্ভাবনা নেই?

সোহরাওয়ার্দী আর ওসমানীর সামান্য যত্নে যা দেয়, তা বিপুল। কিন্তু দক্ষ উদ্যানতত্ত্ববিদের পরিকল্পনা আর পরিচর্যায় তা যা হতে পারতো, তা ভেবে মন খারাপ হয়। সেখানে স্রেফ সারা বছর পাখি আর পোকামাকড়ের সংস্থানের কথা ভেবে গাছ পালা লাগালে, ফলে-ফুলে-মধুতে উদ্যানটা এইসব প্রাণের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে সেখানেও জীবনের প্রাচুর্যে কলকাকলিময় হয়ে উঠবে। প্রাণেরা সেখানে আছেন, তবে আরও বহুগুনে বর্ধিত হবেন।

শিশুদের একদিন রমনাতে নিয়ে যাবেন, দেখবেন তাদের আনন্দ কতগুন বৃদ্ধি পায়, বেঁচে থাকার মানে তারা শিখতে পায়। তেমনটা যদি সোহরাওয়ার্দী আর ওসমানীও হয়ে উঠতে পারে, ক্ষতি কী? জায়গার তো দারুণ অভাব এই শহরে।

মনে আছে একদিন মোহসীন হলে তারেকের ঘরে বন্ধুরা রাত কাটিয়ে সাত সকালে বেড়িয়েছি, সাথে সহপাঠী লিপু। ওদেরই বাসাবোর বাসায় যাবো। হঠাৎই লিপু বললো চল রমনাটা চক্কর দিয়ে আসি। ওইবার সে দেখালো রমনাতে নাগলিঙ্গম গাছের ফুল। লিপু আগে থেকেই চিনতো, কারণ নটরডেম কলেজ। আমি বিস্মিত হয়ে দেখছিলাম সেই মহাকায় গাছটার ফুল, কলি, গাছটার কাণ্ড। সেখানে একটা ফলসা গাছ আছে… বহুকাল ভেবেছি গাছটা আরেকবার ভালো করে খুঁজতে যাবো, খুঁজে পাইনি। আছে আফ্রিকার একটা তুলো (?) গাছ, তার পুরোটা কাণ্ড আশ্চর্য সবুজ! যেন শ্যাওলায় মোড়া, গাছের কাণ্ড তো সাধারণত কালো সাদা বা ধূসর হয়। রমনার সেই সব দিনগুলো এক একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। যত্ন, অর্থ আর প্রয়োজনের একটা অনুভূতি একে এমনটা রেখেছে।

তুলনামূলকভাবে কম প্রয়োজনীয় বলে ভাবা মানুষের একই রকম চাহিদা মেটায় বলে সোহরাওয়ার্দীর গুরুত্ব একটু কম। কিন্তু সেখানে অনেক বিচিত্র গাছ আছে, একটা অদ্ভুদ গাছের কথা এমণ মনে পড়ছে। সম্ভবত বার্মা অঞ্চলের। মিলেশিয়া কী নামটা? পাগলপারা ফুল ফোটানো এই গাছটার ঝরে পড়া ফুলেরা উদ্যানের বুকে গালিচার মত বিছিয়ে থাকে। অপার্থিব সেই দৃশ্য।

এই উদ্যানগুলোর এক একটা নিজস্ব সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছে। ওসমানী উদ্যানে ভর দুপুরে বিশ্রাম নেয়া ঘোড়ার সহিসরা, টোকাই কিশোরেরা নিজেদের জন্য নানান বিনোদনের বন্দোবস্ত করে নিতো, ৯০ দশকে দেখেছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আবার ছিল খেলাধূলার পাশাপাশি চরকি, ছবি আঁকা, যাদু দেখানো এবং এমনি সব ভ্রাম্যমান বিনোদনের সস্তা ও স্বতস্ফূর্ত আয়োজন দেখেছি। গান তো ছিলই।

বলধা নামের একটা ধুঁকতে থাকা উদ্যানও আছে ঢাকাতে। আর আছে পাড়াতো ছোট ছোট মাঝারি সব উদ্যান নামধারী পরিসর। যত ছোট কিংবা বড় হোক না কেন, প্রতিটা উদ্যানের জন্য দরকার এলাকাওয়ারী পরিকল্পনা, যেন তা বিশ্রামের, বিনোদনের এবং শ্রান্তি ভোলার জায়গা হতে পারে। চোখকে ভার মুক্ত করতে পারে। কিন্তু কি বলবো, যে কোন আক্রমণের সব চাইতে বড় খড়্গটা এই সামান্য খোলা পরিসরগুলোর ওপরই সবার আগে পরে।

ঢাকার এক হাত খালি জায়াগাও আর দখলে যেতে দেয়া উচিত না। ভাবা যায়, ঠিক ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিউটের পাশে এখন উচ্চ আদালতের হাতে থাকা জায়গাটা, আগে যা ছিল ‘সড়ক ভবন’, সেখানে আসলে একদা ছিল মাতৃবৃক্ষের একটা উদ্যান! মহাকায়, অতিকায় সব গাছেরা সেখানে ছিল। এখন থেকে চারা ও বীজ সংগ্রহ করে সারা দেশে বিতরণ করা হতো। কোন দিন দেখিনি সেই দৃশ্য, কিন্তু দ্বিজেন শর্মার একটা লেখায় তার বিবরণ পড়ে মনে হয়েছিল, এমন একটা মাতৃবাগান ধ্বংস করতে পারে কারা! এত বড় একটা নৃশংস অপরাধ যে শহরে ঘটতে পারে, তার জন্য অনেক অনেক দুর্যোগ অপেক্ষা করছে। মাতৃবাগান ধ্বংস কি মাতৃহন্তার তুল্য অপরাধ নয়!

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওপর এবার হামলা এসেছে। প্রতিরোধ না করা হলে দিনে দুপুরে কিংবা রাতের আঁধারে চোরাগোপ্তা কায়দায় তাদের এই ডাকাতি চলতেই থাকবে। কারণ এই দেশ কিংবা এই নগরটাকে তারা নিজেদের বলে মনে করে না। কেউ যদি ভাবে তার সন্তানরা এই নগরে বেড়ে উঠবে, তার উত্তর প্রজন্ম এই নগরে নিশ্বাস নেবে, শুধু এইটুকু ভাবনা হৃদয়ে থাকলে এমন সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারতো না।

ফিরোজ আহমেদ
সদস্য, রাজনৈতিক পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন

Leave a Reply