You are currently viewing সরকার জনগণের ‘ম্যানেজারিয়াল’ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ

সরকার জনগণের ‘ম্যানেজারিয়াল’ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ

স্বাস্থ্য নয়, অসুস্থ হবার পর চিকিৎসা পাওয়াটা এদেশে ‘অধিকার’ বলে স্বীকৃত। ওইটুকু ‘অধিকার’ জনগণ কী মাত্রায় ভোগ করতে পারেন তার হাজারো উদাহরণ আমরা দিতে পারবো! বিশেষ করে এই করোনাকালে চিকিৎসাসেবার বেহাল দশা দেশবাসী জীবন-জীবিকার বিনিময়ে প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছেন।

স্বাস্থ্য আর চিকিৎসার মধ্যে বিরাট পার্থক্য; সবচেয়ে মোটাদাগের পার্থক্য হলো- স্বাস্থ্য আগের ব্যাপার আর স্বাস্থ্যহানি হলে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা। আরো পরিষ্কার করে বললে- মানুষ যেনো অসুস্থ না হয় তার ব্যবস্থার নাম হলো- স্বাস্থ্যব্যবস্থা। অসুস্থ্য হবার আগের কাজটা চিকিৎসকের না, রাষ্ট্রের। কী রকম?

করোনার কথাই ধরা যাক- চীন দেশে করোনার অবির্ভাব ঘটলো, জানা গেলো ভাইরাসটা সিরিয়ার, ছোঁয়াচে ও জীবনঘাতী। এবং সেই ভাইরাসটা মানুষের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। তাইলে কী করতে হবে? চীন দেশের মানুষ বা যারা চীনে অবস্থান করছেন- তাঁদের সাময়িকভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না, বৃহত্তর স্বার্থে। তো, এই নিষেধাজ্ঞা কে দিবে? চিকিৎসক নয়, রাষ্ট্র দিবে। যাতে মানুষের স্বাস্থ্যহানি না হয়।

তারপর ধরুন, বায়ু দূষণ। রোধ করবে কে? চিকিৎসক নয়, বরং রাষ্ট্র। বড় বড় শহরগুলোতে যে পরিমাণ দূষণ তার দায় তো সরাসরি দায়িত্বে থাকা সরকারের। বায়ুদূষণের ফলে মানুষের শ্বাসযন্ত্রের যেসকল সমস্যা তার জন্য দায়ী কে? এই দূষণরোধ করার পদক্ষেপ কে নিতে পারে? সরকার।

ধরেন, পলিথিনের আগ্রাসী ব্যবহার। মানুষ তার ‘সহজাত প্রবণতা’য় নিয়ম মানার প্রাণী না বলে আমরা অনেকেই ব্যাখ্যা দেই। কিন্তু মুশকিল হলো- যা যা নিয়ম আজ মানুষ মানে, তা কি কোনো ‘সুচিন্তিত পদক্ষেপ আরোপ’ ছাড়া আপনি আপনিই মানুষ মানতে শিখেছে? মোটেও না। এখন, পলিথিন ব্যবহার করে মানুষের জীবন দৃশ্যত অনেক সহজ হয়েছে, লং রানে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব আছে। তা হয়তো সাধারণ মানুষকে তেমন একটা বিচলিত করে না। তখন রাষ্ট্র কী করবে? রাষ্ট্র মানুষকে পলিথিনের বিকল্প দিবে, সচেতন করবে, বাধ্য করবে। যাতে করে ওই নিয়মটা সে শিখে ফেলে, মেনে নেয়। আমরা কী দেখি? পাটের তৈরি ‘সোনালী ব্যাগ’ যেটা পলিথিনের বিকল্প, সেটার উৎপাদন আমরা দেখি না। বরং পাটকল বন্ধ করতে দেখি।

পানি দূষণের কথা ধরুন, একই পরিস্থিতি। এই রকম প্রত্যেকটা খাত নিয়ে ভাবলেই একই অবস্থা দেখা যাবে। সেসব পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের সক্রিয় উদ্যোগ বা সক্রিয় মদদ।

এমনকি, প্রতিদিন যে মানুষগুলো সড়কে মারা যান, এই দায়টাও কিন্তু তেমনই। ধরেন, আপনি রাতে বাইক নিয়ে ফার্মগেট থেকে মিরপুর ১০ নম্বর যাচ্ছেন- হঠাত সামনে দেখলেন রাস্তার মাঝখানে গর্ত! আপনি হার্ড ব্রেক করলেন, আপনের পেছনের পিলিওন উড়ে গিয়ে পড়লো, আপনের পেছনে ধাক্কা মারলো একটা বাস। ব্যাস, আপনি আরো দুএকজনকে নিয়ে ওপাড়ে চলে গেলেন। তাইলে, এবার বলুন, এটা কী এ্যাক্সিডেন্ট? না, এটা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। রাস্তায় গর্ত ভরাট করার দায়িত্ব, কিংবা ভরাট করার আগ পর্যন্ত সেটাকে ঘিরে রেখে চালকদের সতর্ক করার দায়িত্ব নিশ্চয় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার।

কিংবা ধরেন, কয়েকদিন আগে একটা জাহাজের ধাক্কায় একটা যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে ৩৪ জন মানুষ নিহত হলো। এটাকে কী বলবেন? এ্যাক্সিডেন্ট? না। কারণ, ওই জাহাজটা নদীপথে চলার অনুমতিই পেয়েছিলো না। তাইলে চললো কিভাবে? ক্ষমতার জোরে। এখন ওই জাহাজ ঠেকানোর দায়িত্ব কার? জনগণের? না। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের।

এই রকমভাবে প্রতিটা ক্ষেত্রেই মানুষকে অসুস্থ বানানোর, খুন হবার, করার, খুনী হবার, নিহত হবার, নিঃস্ব হবার… সকল আয়োজন এই রাষ্ট্র অতি সুচারুরূপে সম্পন্ন করে থাকে। ‘জনগণের রাষ্ট্র’ বা ‘জনস্বার্থের রাষ্ট্র’ তাকেই বলা যায়, যেটা জনগণকে রক্ষার, জনগণকে ভালো রাখার ব্যবস্থা করে। গণমুখী রাষ্ট্র সেটাই, যেটা মানুষের চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজনীয়তা কমানোর জন্য সচেষ্ট থাকে।

করোনা মহামারীর ‘প্রায়’ সকল দায় এই রাষ্ট্রের, এই সরকারের। এই কথা পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে। কারণ- করোনা মহামারীর মতো মহামারি ঠেকানোর জন্য ব্যবস্থাপক লাগে, ম্যানেজার লাগে। বাংলাদেশের মানুষের সম্মতি নিয়ে হোক বা না নিয়ে হোক- বর্তমান সরকার বর্তমানকালের রাষ্ট্রীয় ম্যানেজার। ফলে, দায় তাকেই নিয়ে হবে। এই সরকারকে জনগণ যে চাকুরী ‘দিয়েছে’, তা পালনে তারা পুরোপুরি ব্যার্থ। জনগণকে ‘নতুন দায়িত্বশীল ম্যানেজার’ খুঁজে বের করতে হবে, যে ম্যানেজার- চিকিৎসার আগে স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিবে, জনজীবনকে দিবে অগ্রাধিকার।

সৈকত মল্লিক
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন
সংগঠক, গণসংহতি আন্দোলন

Leave a Reply