You are currently viewing ৩০ ডিসেম্বর ‘আওয়ামী প্রতারনার’ কালো অধ্যায়ঃ রাতের ভোটের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা

৩০ ডিসেম্বর ‘আওয়ামী প্রতারনার’ কালো অধ্যায়ঃ রাতের ভোটের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা

আজ আবার এসেছে ৩০ ডিসেম্বর। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছিলো। নির্বাচনের আগের দিন রাতে পুলিশ ও প্রশাসনের মাধ্যমে ব্যালটবাক্স ভর্তি করে রেখে এদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসের অভূতপূর্ব ঘটনা আওয়ামিলীগ ঘটিয়েছিল। বাংলাদেশ জন্মের পর ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামিলীগের কতৃত্বেই হয়েছিল। তখন কুখ্যাত খন্দকার মোশতাক আহমেদকে কুমিল্লাতে জয়ী ঘোষণা করতে ব্যালটবাক্স হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে এসে ফলাফল ঘোষণার রেকর্ডও ছাড়িয়ে গিয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালে। ১৯৭৩ সাল থেকে নিয়ে ১৯৯০ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে এদেশের মানুষ কথা বলতে ভুলে গিয়েছিল। স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পর থেকে নির্বাচন নিয়ে মানুষের আশবাদ শুরু হয়েছিল। ‘ভোট ও ভাতের অধিকার’ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করার ওয়াদা দিয়েই রাজনীতি শুরু করেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরিনত জীবনে এসে তিনি ম্যকিয়াভেলীর চাতুরি দিয়ে এমন ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, তার নিজ দলীয় লোকজনই এসব নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করা ছেড়ে দিয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো দুইবছর পরে এসে সম্প্রতি দেশের ৪২ জন নাগরিক রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছেন নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ এবং অর্থিক দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণের জন্য। ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দিয়ে নির্বাচন কমিশনের বিচার চেয়েছেন যা কিনা ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকেই রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সকল শ্রেনী পেশার মানুষের বলা দরকার ছিলো।

কী হয়েছিল সেই নির্বাচনে? 

সরকার রাতের আঁধারে ভোটের বন্দোবস্ত করে  বিজয় নিশ্চিত করেছে। দিনের বেলা ভোটারদের ভোট কেন্দ্র থেকে দূরে রাখা হয়েছিলো। ভোট দিতে এসে ভোট দিতে পারেননি। কিছু যায়গায় দিনের বেলাতেও ক্ষমতাসীনরা প্রকাশ্যে ভোট দিয়েছেন। ব্যতিক্রম কিছু যায়গায় ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে ভোট দেয়ায় ধর্ষণের শিকারও হয়েছেন ভোটাররা। সর্বপরি,  বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে অপমান করা হয়েছে। ১১ কোটি ভোটারকে খুবই পরিকল্পিতভাবে অপমান করা হয়েছে। প্রকারান্তরে পুরো বাংলাদেশকে অপমান করা হয়েছে, এবং অপমান করেছে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট (যেখানে আরো অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহন ছিলো)।  এই রাষ্ট্রের এলিট ও দুর্নীতিগ্রস্থ আমলাতন্ত্র, লাঠিয়াল পুলিশ বাহিনী, লুটেরা ব্যবসায়ী শ্রেণি, মেরুদন্ডহীন গণমাধ্যম। কেউ এই দায় এড়াতে পারেন না।

একজন প্রার্থী বা রাজনৈতিক কর্মীর অভিজ্ঞতা

যদি বলা হয় সবচেয়ে হতাশার সময় কোনটি?  একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি বলবো  ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পরের সময়টি। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে জনগণের সামনে নিজেকে বিচারের সবচাইতে বড় মাধ্যম হতে পারে নির্বাচনে অংশগ্রহণ। সে রকম একটি আকাঙ্খার জায়গা থেকেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। পেশি শক্তি ও টাকার খেলার নির্বাচনে নিজেকে যাচাই করার সুযোগ হয়তো খুব বেশি নেই। আবার একথাও সত্য পেশি শক্তি ও টাকার খেলার সংস্কৃতিকে মোকাবেলা করতে হলে তার মুখোমুখিই হতে হবে। এড়িয়ে গিয়ে বাহিরে থেকে বড় বড় কথা বলে এ অবস্থার পরিবর্তন করা কি সম্ভব? বৃহত্তর গণঅভ্যুত্থান হলে হতে পারে। তবে আমরা কেন সকল পদ্ধতিতে যুগপৎ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো না? এরকম বিবেচনায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহন করেছিলাম।

নির্বাচনী প্রচারণার শেষদিন সিএন্ডবি বাসস্টান্ডের পথসভা তারিখঃ ২৮.১২.২০১৮ ।

নির্বাচনে অংশগ্রহণ একটি রাজনৈতিক দলের যেমন অধিকার, তেমনি একজন ব্যক্তিও স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রেখে নির্বাচনে অংশ্রগহণ করতে পারেন। কিন্তু কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি না হলে কারো পক্ষে স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইলে পরতে হবে এক সীমাহীন চ্যালেঞ্জের মুখে। নির্বাচন কমিশন স্বতন্ত্র প্রার্থিদের জন্য এরকম একটি প্রতিবন্ধতকতা রেখেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থিকে মোট ভোটের ১ শতাংশ আগাম সমর্থন নিয়ে মনোয়ন প্রত্রের সাথে জমা দিতে হবে। এরমধ্যে যদি কোন একজন সমর্থনকারীও ভুল করে উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলে তাহলে প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যেতে পারে। রিটার্নিং কর্মকর্তা চাইলেই যে কারো মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন। অনেক ধরণের ছুতা নাতা তার হাতে দেয়া হয়েছে- আইনের মাধ্যমে। যা সংবিধান পরিপন্থী বলে আমি মনে করি। আমার ক্ষেত্রে এরকম একটা চেষ্টা হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক মহলের পর্যবেক্ষন

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) ২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক বা ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের তালিকাতেও প্রদান পায়নি। স্বৈরতান্ত্রিক ও ত্রুটির্পূণ গণতান্ত্রিক এই দুই ক্যাটাগরির মাঝখানে ‘হাইব্রিড রেজিম’ এর তালিকায় অর্ন্তভূক্ত দেখানো হয়েছে। দি ইকোনমিস্টের ভাষায় হাইব্রিড রেজিমের যে বৈশিষ্টগুলো দেখানো হয়েছে সেগুলো দেখা যাকঃ  ১)নির্বাচনে বেশ অনিয়মের ঘটনা ঘটে;  ২) বিরোধী দল এবং প্রার্থীর ওপরে সরকারি চাপ খুবই সাধারণ ঘটনা;  ৩) রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সরকারের সক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিষয়ে মারাত্মক দুর্বলতা দেখা যায়,  ৪) দুর্নীতির বিস্তার প্রায় সর্বত্র এবং আইনের শাসন খুবই দুর্বল; ৫) সিভিল সোসাইটি দুর্বল; ৬) সাংবাদিকরা সেখানে হয়রানি ও চাপের মুখে থাকেন এবং ৭) বিচার ব্যবস্থাও স্বাধীন নয়।

ইকোনমিস্ট একে যে নামেই ডাকুক বা যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক বাংলাদেশে গত ৩ দশক ধরে এই বৈশিষ্টগুলো প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। এর সর্বোচ্চ নিদর্শন দেখলাম আমরা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় নির্বাচনে। দি ইকোনমিস্ট বলছে নির্বাচনে বেশ অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। আর আমরা দেখলাম ২০১৮ সালে তৎকালীন  প্রধানমন্ত্রী সকল রাজনৈতিকক দলের সাথে সংলাপ করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিলেন। তিনি বললেন আমার ওপর আস্থা রাখেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। তাঁর ওপর আস্থা রেখে সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহন করেছে। কিন্তু তিনি তাঁর ওপর রাখা আস্থা কিভাবে প্রতিপালন করেছেন সে অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের হয়েছে।

জনসাধারণ কি ভাবছেন?

প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারন মানুষ তো বিশিষ্টজনদের মতো বিজ্ঞ মতামত দেন না। তারা জানেন এই রাষ্ট্র শুরু থেকেই তাদের অপাংক্তেয় বিবেচনায় রেখেছে।  সুতরাং তারাও রাষ্ট্রকে কতটা নিজেদের ভাবেন আর কতটা অন্যদের ভাবেন সেটা পরিষ্কার করে বোঝা খুব কঠিন।  তারা বিভিন্ন রকম ইয়ার্কি করেন। চায়ের দোকানে নিজেদের পরিসরে এই সরকারের নির্বাচন নিয়ে তাদের রসিকতা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় না আসার কারণে বা লেখার সুবিধা না থাকায় তারা ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্টে মামলায় পরেননা বটে, তবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত জণগনের ভাষা বড় নির্মম। ক্ষমতাসীনদের তখতে তাউস জ্বালিয়ে দেবার মতো জ্বালানি লাঞ্ছিত জণগনের বুকে ধিকিধিকি জ্বলছে। আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষের আক্ষেপ থেকে, শ্রমিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে বলে রাখি, জণগন বিভিন্ন রকম ক্ষোভ পুষে রাখেন। এই পুষে রাখা ক্ষোভ বারবার প্রকাশ্য বিক্ষোভের রূপ নিয়ে বিভিন্ন গণ আন্দোলন গড়ে উঠছে। হারানো নাগরিক মর্যাদা ফেরত পেতে তাঁরা শ্রীঘ্রই জেগে উঠবেন আবারো কেউ সত্যিকার অর্থেই ‘ভোট ও ভাতের অধিকার’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ডাক দিলেই।

লেখকঃ জুলহাসনাইন বাবু

সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য , গণসংহতি আন্দোলন। সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি। পাবনা-১( সাঁথিয়া-বেড়া) আসনে সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী ছিলেন।


Leave a Reply