You are currently viewing রোকেয়া এবং আমাদের সময়: আমরা কি জেগেছি ?

রোকেয়া এবং আমাদের সময়: আমরা কি জেগেছি ?

ভগিনীগণ। চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন-অগ্রসর হউন। বুক ঠুকিয়া বল মা!
আমরা পশু নই; বল ভগিনী। আমরা আসবার নই; বল কন্যে। আমরা জড়াউ
অলঙ্কার-রূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বল; আমরা মানুষ ! “
-রোকেয়া (বেগম তরজীর সহিত সাক্ষাৎ, পৃ-২৭২)

১.
খুব অল্প বয়সে যখন থেকে আর দশটা মানুষের মতো শিখছি কোনটা ভাল কোনটা মন্দ, কোনটা সামাজিক কোনটা অসমাজিক, কে ধার্মিক কে অধার্মিক, কে মুসল্লী আর কে না, কে ভদ্দরলোক আর কে ছোটলোক, তখন থেকেই ইত্যাকার সামাজিক শিক্ষার আয়োজনের সীমানায় রোকেয়াকেও চিনেছি। জেনেছি আর দশজনের মতো আটপৌরে রোকেয়া মুসলিম নারীর জন্য শিক্ষার অগ্রদূত। সমাজ আর পর্দার মধ্যে থেকেই রোকেয়া মুসলিম নারীর শিক্ষার জন্য কাজ করেছেন।

তখন মনে হয়েছিল ঘোমটা পড়া মহিয়সী সেকেলে এক ‘ভদ্রমহিলা’ রোকেয়া, যিনি আরো অনেকের মতো নারী শিক্ষার জন্য মেলা কিছু করেছেন, যিনি সমাজের নানা কালে সমাজ সংস্কারকদেরই একজন, যিনি পুরনোকালে পুরনো সমাজকে না চটিয়ে বরং তাদের মন রক্ষা করেই কাজ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর চেয়ে বড় কোন কৌতূহল বা উৎসাহ কাজ করেনি ঐ কাঁচা বয়সে। আমি হলফ করে বলতে পারি একই রকম অনুভূতি আমাদের অঞ্চলের বেশীর ভাগ সাধারণ পাঠকেরই যারা পাঠ্যবই এবং সমাজের আধিপত্যশীল প্রচারণার মাধ্যমেই রোকেয়াকে জানেন।

সমাজের অংশ, একজন মানুষ এবং নারী হিসেবে নিজের অবস্থান এবং অস্বস্তিকে নিয়ে যখন উসখুস করছি আর ক্রমশ বেয়াড়া হয়ে উঠছি তখনই প্রথম পুরনো ভাবনায় ফাটল ধরে, রোকেয়াকে নতুনভাবে আবিষ্কার করি। বলতে দ্বিধা নেই হাই স্কুল পাড়ি দেবার পর রাজনৈতিক কর্মী হবার সুবাদে এবং নিজেকে নারী মুক্তির লড়াইয়ের একজন যোদ্ধা হিসেবে দাবি করার দায় থেকেই রোকেয়াকে প্রথম পাঠ করি নতুনভাবে। রোকেয়া পাঠের প্রাথমিক অনুভূতিটা ছিল রীতিমতো নিজেকে এবং জীবনকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার মতোন পরম অনুভূতি। নারী আন্দোলনের বিরাট সম্পদ এবং সম্বল আর শক্তি হিসেবেই আমরা যেন রোকেয়াকে পেলাম।

ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিক সত্তা হিসেবে ঋণী হয়ে পড়ি বিশেষভাবে রোকেয়ার কাছে, একই সাথে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কাছে যা আমাকে উৎসাহিত করেছে রোকেয়াকে নতুনভাবে পাঠ করতে। রোকেয়ার প্রতি ঋণের বোঝা সমাজের বাদ-বাকিদের কাঁধেও কিছুটা চাপানোর আকাক্সক্ষায় এ বিষয়ে আমাদের ভাবনা-পাঠপর্যালোচনা আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করতে চাই। আমার মতো বহু পাঠকের বিশেষভাবে নারী পাঠকদের রোকেয়াকে প্রাণ দিয়ে পাঠ করার ও তার জীবন ও কাজের সাথে পরিচিত হবার অনুভূতি কাছাকাছি রকমই হবার কথা বলে আমার ধারণা। ব্যক্তিগতভাবে রোকেয়া পাঠ পরবর্তী প্রথম চোটের ধাক্কাগুলো প্রায়ই নানান অস্বস্তিকে স্মরণ করিয়ে দিত, পরে সেসব অস্বস্তি নিজের চিন্তা ও অবস্থান তৈরিতে সাহায্য করেছে। ওসব বিষয়ের কথাগুলো মনের আগল খুলে বিনিময় করতে চাই আপনাদের সাথে।

নারী হয়ে জন্মাবার কুফল-অপকারিতা এবং নানা অসুবিধার তালিকা করতে গিয়ে শিশুকাল থেকেই আমার মতো প্রায় সকল নারীকুলেরই স্বয়ং হিমশিম খেতে হয়। আর সারাবেলা নিজের মধ্যে কুঁকড়ে থাকতে হয় গুটি পোকার মতো। পাশাপাশি সমাজ-চারপাশের সাথে মন কষাকষি-ঝগড়া-বিবাদ আর যুদ্ধাংদেহী হয়ে ওঠার আকাঙ্কা নিয়েও আবার চুপসে পড়তে দেখা যায় আমাদের নারীদের। এসবের মাঝে ঘুরে ঘুরে ভেবেছি কোথায় আমার ঠিকানা, নারীর ঠিকানা, কী তার পরিচয়, কী তার স্বপ্ন নিজ এবং চারপাশকে ঘিরে। ঘুরে ঘুরে এই প্রশ্নগুলোই জ্বালা বাড়াতে থাকে। খুঁজে হন্যে হই নারীর ‘জগৎ’, ‘ভাবনা’, ‘মত’ কোথাও তার সুবর্ণরেখা উজ্জ্বলভাবে দেখা দেয় না। কোথাও কোথাও বিদ্যুতের মতো ঝলকানি দিলেও তার আর খোঁজ মেলে না।

যতবার পরিবার-পরিজন সম্পর্ক ইত্যাদির টানাপোড়েনে দুমড়ে মুচড়ে যাবার অবস্থা হয়েছে ততবারই আবিষ্কার করেছি নারীর ‘জগৎ’ ‘মত’ ‘ভাবনা’ সর্বোপরি কর্তাসত্তা জমিনে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারে নি। যে কারণে নারীর ভাবনা হয়ে গেছে পুরুষের ভাবনা, বুঝে না বুঝে নারীর দর্শন হয়েছে পুরুষের আদর্শিক অবস্থান। কখনো কিছুটা অবস্থান দানা বাঁধলেও তা খুব দ্রুতই মিলিয়ে গেছে। যথাক্রমে নারীর কাছে ‘পুরুষ কিংবা প্রেমিক কিংবা স্বামী’ পরিণত হয়েছে আদর্শিক নেতায়। নারীর পথ ও মত দুটোই তাতে গিয়ে মিলেছে। সমাজের দুই অংশ নারী-পুরুষ যেখানে পাশাপাশি দাঁড়াবার কথা তার পরিবর্তে সেখানে পুরো জায়গায় আসন জুড়ে গেড়ে আছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও এর মনোভাবনা।

বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন ও পণ্যায়নের জমানায় নতুন শ্রমশক্তি হিসেবে নারীর উপস্থিতি কিংবা পরিবারের গঠন-কাঠামোর পরিবর্তন, নারীর পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি স্বীকৃত-অস্বীকৃত উভয় পেশায় যুক্ততা, শ্রমিক নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি নারীর অবস্থান ও মনোজগতের ঢেড়ঢেড় নড়চড় ও রদবদল ঘটিয়েছে সন্দেহ নেই। অফিস-আদালতে-অন্দর-বাহির মহলে, বাসে-রাস্তায় নারী পূর্বের তুলনায় সরব, কখনো কখনো নারীর নতুন নতুন ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, বিবাদ বাড়ছে, নারীর স্বর শোনা যাচ্ছে কিন্তু চর্চার ক্ষেত্রে কিছু সময় পরই কোথায় যেন পিছুটান সেই স্বরকে হাওয়ায় মিলিয়ে দিচ্ছে। সেই ঘর সেই সংসার সেই স্বামী-সন্তান এর দুর্ভাবনা নারীর জগত হয়ে পিছু টেনে ধরেছে। স্বামীর জন্য মুখরোচক খাবার পরিবেশনের আয়োজন, ঘরটাকে তকতকে রাখা, আদর্শ মা হবার প্রাণান্ত চেষ্টা আর আধুনিক জমানার সাথে তাল মিলিয়ে শরীরটাকে টানটান কাটিং-এ রাখাই যেন জীবনের সার কথা আকারে চর্চিত হয়ে চলেছে।

এসব এত এত কথায় কেউ ভাবতে পারেন আমি চরম পুরুষবিদ্বেষী হয়েছি এবং শুধু তাতেই ক্ষান্ত হই নি বরং রোকেয়ার গীত গাইতে গিয়ে সমাজ-সংসার সব গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনের মুখে চুনকালি লেপন করছি। ভাবছেন এ কিসের আলামত? কী এর উদ্দেশ্য? এসবের সাথে রোকেয়ার সম্পর্কই বা কী? সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে, সেই আলাপেই ঢুকছি, আশা করি ততক্ষণ আপনারা ধৈর্যহারা হবেন না। এতসবের মোদ্দা কথা এই যে, নারীর এত এত কাজকর্ম বিএ-এমএ-পিএইচডি ডিগ্রি লাভ, এসবের পরও সমাজের গড়া নিয়মের সীমা ডিঙ্গিয়ে নিজের ‘জগৎ’ আর ‘সত্তা’ নির্মাণে নারী ব্যতিব্যস্ত হতে পারে নি। কেন পারে নি? সামাজিক ব্যবস্থা ও বিধিবিধান তাকে পারতে দেয় নি। কিন্তু এর অন্য কারণ বোধ করি নিজের জগতের নিশানা নির্ধারণ করতে না পারার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। নিজের জগৎ বলতে যেন বারংবার পুরুষ-স্বামী-সংসার এসকল বিষম দুষ্টুচক্রের গন্ডির মধ্যেই আমাদের আটকে থাকা। ফলে ‘জগৎ নির্মাণের’ কাঠখড় পোড়া অনলে অবগাহন করার চেয়ে পরিবার এবং সমাজের ‘নিরাপত্তা বলয়ে’ দিনানিপাত করা, নিজ এবং সকলের তরে যে অমূল্য জীবন তাকে বলি দেয়াই যেন মহান আত্মত্যাগী নারীর চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। এ শিক্ষাই আদর্শ মেনে জীবনপাত করি আমরা ‘নিঃ‘শব্দে’! ‘স্বসম্মানে’!!

২.
নারী কে, তার জগৎ কী, সে কি নিজ না অপর, কে তারে গড়ে-ভাঙ্গে বিযুক্ত শ্রমের যন্ত্রণার মতো এসব কঠিন কঠিন প্রশ্ন হাতুড়ি পেটা করে, হুলস্থুল হয়ে তাড়া করে বেড়ায়। কেবল শরীরে-মাংসে একটি আলাদা সত্তা হয়ে, অনেকটা ব্রিটিশ আমলে মেকলের শিক্ষানীতির প্রশিক্ষণের গড়নে নারী মননে-মগজে হয়ে পড়ে পুরুষের সেবাদাস। এখানেই রোকেয়া মরমীয়া-পরম দরদী বন্ধু হয়ে কাছে দাঁড়ান। যিনি সেকালেও নারীর সত্তাহীনতাকে নারী মুক্তির অন্যতম সংকট হিসেবে সকলের সামনে হাজির করতে ভুলেননি।রোকেয়া স্ত্রীজাতির অবনতি প্রবন্ধটি শুরু করেন এই বলে- পাঠিকাগণ! আপনারা কি কোন দিন আপনাদের দুর্দশার বিষয় চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন? এই বিংশ শতাব্দীর সভ্যজগতে আমরা কি? দাসী! পৃথিবী হইতে দাস ব্যবসা উঠিয়া গিয়াছে শুনিতে পাই, কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কী? (স্ত্রীজাতির অবনতি, পৃ-৯)

ব্যক্তির সম্মান বা সামগ্রিকভাবে সকল নারীকূলের সম্মানহানীর কাজ রাষ্ট্র-সমাজ তার মতাদর্শ ও স্বার্থ অনুযায়ী সুসংগঠিতভাবে পরিচালনা করে। কিন্তু আধুনিক দাস হিসেবে নিজেদের অবস্থা নতুন মাত্রায় হাজির হওয়া কিংবা সমাজশৃঙ্খলে বন্দি থাকার পেছনে আমাদের নিজেদের দায় নিয়ে, আমাদের অধীনতা-নীরবতা-নিষ্ক্রিয়তা এই দাসত্বকে যেভাবে নতুন ঘেরাটোপে বন্দি করে, দীর্ঘস্থায়ী করে সেইসব প্রসঙ্গ মোকাবেলা না করে সমাজে নারীর অবস্থান পরিবর্তনের পথ কি অগ্রসর হতে পারে? এসকল প্রশ্ন-ভাবনার সাথে আত্মমর্যাদা-আত্মসম্মান-আত্মদর ইত্যাদির নিবিড় সম্পর্ক আছে। নারীর জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে রোকেয়া সেই শিক্ষাকেই প্রশ্ন করেছেন, কখনো প্রত্যাখ্যান করেছেন যা প্রতিমুহূর্তে নিজেকে অসম্মানিত করার, ‘আত্মদর’ লোপ পাবারই শিক্ষা দেয়। রোকেয়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু নারীকুলকে আহ্বান করেছেন মানুষ হবার শিক্ষায় শিক্ষিত হবার জন্য। মানসিক দাসত্বের নিগঢ়কেই রোকেয়া বার বার এমনভাবে খোঁচা দিয়েছেন যা আজকের জমানায় কোনমতে সমাজের শেকড় আগলে থাকা আত্মমর্যাদাহীন ব্যক্তিটিরও গায়ে কিছুটা হলেও ফোস্কা ফেলতে সক্ষম হবে। অতি ভোঁতারা অবশ্য এ তালিকার বাইরে থাকবেন। রোকেয়া নারীর আত্মপ্রশ্নে আলাপ তোলেন-  “…এই রূপ আমাদের আত্মদর লোপ পাওয়ায় আমরাও অনুগ্রহ গ্রহণে আর সঙ্কোচ বোধ করি না। সুতরাং আলস্যের, প্রকারান্তরে পুরুষের-দাসী হইয়াছি। ক্রমশ আমাদের মন পর্যন্ত দাস হইয়া গিয়াছে এবং আমরা বহুকাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসত্বে অভ্যস্থ হইয়া পড়িয়াছি। এইরূপে আমাদের স্বাবলম্বন, সাহস, প্রভৃতি মানসিক উচ্চবৃত্তিগুলি অনুশীলন অভাবে বার বার অঙ্কুরে বিনাশ হওয়ায় এখন আর বোধ হয় অঙ্কুরিতও হয় না। কাজেই পুরুষজাতি বলিতে সুবিধা পাইয়াছেন………. স্ত্রীজাতির অন্তঃকরণের পাঁচটি দুরারোগ্য ব্যাধি……. অযোগ্যতা, অসন্তোষ, পরনিন্দা, হিংসা এবং মূর্খতা।……… নির্বোধ স্ত্রী লোকের কর্তব্য যে প্রত্যেক বিষয়ে নিজেকে অবিশ্বাস করিয়া স্বামীর আদেশ পালন করে।“ (স্ত্রী জাতির অবনতি, পৃ-৯-১৯)

খুব ছোটবেলা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হবার পুরো সময়কাল জুড়ে পরিবার-স্কুল-রাষ্ট্র থেকে চাই বা না চাই নারী হিসেবে যে পরিচয়লিপি বহন করে বেড়াচ্ছি তাতে আমরা নিজেকে চিনেছি অধম, অপূর্ণাঙ্গ, চিন্তাহীন গতর সর্বস্ব জড়সুলভ প্রাণীবিশেষ রূপে। এর চেয়ে বেশি কিছু আমরা নিজেদের ভাবতে শিখি নি। নিজসহ চারপাশ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এখনও অর্জন করি নি। কাজ নিজের পরিচয় হিসেবে না দাঁড়িয়ে, পরিবার পরিজন, শরীর-সৌন্দর্য্য-অলঙ্কার-সহায়-সম্পত্তি এসবই পরিচয়ের নির্ধারক হয়েছে। সেই দিকগুলো তীক্ষ্ণভাবে রোকেয়া নজরে এনেছিলেন। সেই নজরের সাথে নজর মেলানোর সাহস আমাদের এখনো সঞ্চিত হয় নি কিন্তু রোকেয়া নিঃশঙ্কোচে বলেন- “আমাদের অতিপ্রিয় অলঙ্কারগুলি……… বাস্তবিক অলঙ্কার দাসত্বের নিদর্শন ভিন্ন আর কিছু নহে। যদি অলঙ্কারকে দাসত্বের নিদর্শন না ভাবিয়া সৌন্দর্য বর্ধনের উপায় মনে করা হয়, তাহাই কি কম নিন্দনীয়? সৌন্দর্য্য বর্ধনের চেষ্টাও কি মানসিক দুর্বলতা নহে।” (স্ত্রীজাতির অবনতি, পৃ-১৩)

আমরা ঘসে মেজে ‘সৌন্দর্য্য বর্ধনের’ যে চেষ্টা করি তার কিয়দংশ নিজের ভালোলাগার জায়গা, সুকুমারবৃত্তির জায়গাগুলোতে খরচ করতাম তাহলে এভাবে নারীর আত্মদর নিশ্চয়ই লোপ পেত না। নারীর ‘রূপ;  সৌন্দর্য্য’ তার পরিচয় না হয়ে কাজই তার পরিচয়ের নির্ধারক হতো। কিন্তু সেই সুযোগ কই? পুরুষের চাওয়া পাওয়ায় আমরা যা তাকেই আমরা আবার গড়াতে চাই। যে সামাজিক আয়োজনের মধ্যে আমি এবং আমার ভাই কিংবা সমাজের অন্যদশজন পুরুষ থাকেন তাদের সাথে সমান তালে বেড়ে ওঠার পথগুলো বন্ধ থাকায়, কাঠপুত্তলিকার মতো বেড়ে উঠে আমরা লড়াইয়ের ময়দানে হাজির হই, নিজেদের পরিবর্তন না করে টিকে থাকার জন্যে প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য হই। রোকেয়ার ভাষায়- ‘উড়িতে শিখিবার পূর্বেই আমাদের ডানা কাটিয়া দেয়া হয়’ (সুলতানার স্বপ্ন, পৃ-১২৫)। আর ময়দানে কিছুদূরে গিয়ে যখন পা পিছলে পড়ি তখন বলা হয় নারীরা কাজ করেন না, পারেন না, এরা অলস, এরা সুযোগ চায়, কোটা চায়। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই কেবল পুরুষ হয়ে জন্মবার কারণে যারা সমাজের যাবতীয় সুবিধা গ্রহণ করে সেই পুরুষরাই এসব নিয়ে চিৎকার তোলে।

অথচ আমরা নারীরা যদি গৃহকাজ থেকে অবসর পেয়ে নিজের সৃজনশীলতা বিকাশে ব্যস্ত হতে পারতাম তাহলে হয়তো আমাদের পুরুষ মহাশয়দের সৃজনশীলতা আর সুকুমারবৃত্তি চর্চার সুযোগ টান পড়তো। ঘর-সংসার-সন্তান-শরীর এসব ঠিক রেখে পুরুষের সৃজনশীল সত্তা টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের কাজের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে নিঃশেষ হই আমরা। আর ঐ পরিশ্রমের ওপর ভর করে যে সৃজনশীল তৎপরতার সৌধ নির্মাণ করেন পুরুষ, সেই সৌধকে অটুট রাখার বাড়তি কাজ নারীর ওপর চেপে থাকায় নারী চাইলেও কাজে মন বসাতে পারেন না। সারাক্ষণ জীবনের ভার বয়ে বেড়াতে বেড়াতে ক্লান্ত হয়ে থাকে। নারী শ্রমজীবী মধ্যবিত্ত যেই হোন তার শ্রমের ওপর ভর করেই পুরুষের সৃজনশীল সত্তা বিকশিত হয়। নারী পুরুষের দ্বন্দ্বে নারী প্রলেতারীয়েতের জায়গায় এসে পড়ে। রোকেয়া এই বিষয়টিকেও লক্ষ্য করেন এবং বলেন- “যে স্থলে দরিদ্র স্ত্রীলোকেরা সূচির্ক বা দাসীবৃত্তি দ্বারা অর্থ উপার্জন করিয়া পতিপুত্র পালন করে, সেখানেও ঐ অকর্মণ্য পুরুষেরাই ‘স্বামী’ থাকে। আবার যিনি স্বয়ং উপার্জন না করিয়া প্রভূত সম্পত্তির অধিকারীণীকে বিবাহ করেন। তিনিও ত স্ত্রী উপর প্রভুত্ব করেন এবং স্ত্রী প্রভুত্বে আপত্তি করেন না।“ (স্ত্রীজাতির অবনতি, পৃ-১৯) সমাজে নারীর নড়বড়ে আত্মকে খুঁজে না পাবার এবং স্বাধীন সত্তার অভাবের দুর্ভাবনাকে নানা কায়দায় যে মাত্রায় হাজির করেছেন রোকেয়া, সেটা তাই নারী মুক্তির জন্য অত্যন্ত জরুরি দিক। আর তাই প্রায়শই জীবন যাপনের প্রতিদিনের অতি তুচ্ছ খুঁটিনাটি যা, খুঁটিনাটি হওয়া সত্ত্বেও দরকারি সেসকল দিক হাত পিছলে এড়িয়ে যেতে দেখা যায় বিশেষভাবে পুরুষ লেখকদের লেখায়। দুঃখের বিষয় আমাদের নারী আন্দোলনেও জোরের সাথে এই দিকগুলো এখনো উপস্থিত নয়।

৩.
নারী সৃষ্টিগতভাবেই হীন, সমাজের এই আদর্শের বেড়াজাল তাই নারীই এখনও ছিন্ন করতে পারে নি। চারপাশ থেকে আমরা জেনে আসছি নারীর বুদ্ধি কম, মাথা কাজ করে না, নারী সৃষ্টি করে না, মাথা খাটানোর কোন কাজেই পারদর্শী নয় নারী। যেন নারী এক মস্তিষ্কবিহীন প্রাণী, যে চিন্তা এবং পরিবর্তনে অক্ষম। ধর্মীয় সমর্থন এক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয় অথচ ধর্মীয় গ্রন্থে আমরা পাই সকল মনুষ্য জীব আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। কারণ প্রাণীকুলের মাঝে মানুষই সেই প্রাণী যে চিন্তা করতে ও পরিবর্তন করতে পারে। সেখানেই মানুষের বিশিষ্টতা। তাহলে নারী কি মানুষ নন? কেবলই চাবি দেয়া পুতুল-যেমন বলায় তেমনি বলে-চিন্তাহীন জ্ঞানহীন প্রাণহীন জড়বস্তু ! আর সেই প্রাণহীনদের নানা চিত্রায়ণ কালে কালে আমরা পাঠ্যপুস্তকে-সাহিত্যে-সমাজের আনাচে কানাচেই নির্মিত হতে দেখি, প্রতিধ্বনিত হতে দেখি, রোকেয়া সেই সামাজিক রং-এ রাঙানো নারীর রূপগুলো আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। আয়নায় নিজের চেহারার দুর্বল ও ভগ্নদশার খুঁটিনাটি ধরা পড়লে যেমন অস্বস্তি তৈরি হয় তেমনি রোকেয়া ব্যঙ্গ-বিদ্রুপসহ সমাজে পরিচিত আমাদের সেই ভগ্নদশাগুলোকে দেখিয়ে আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে দেন। নারী সৃষ্টিতে তিনি বলেন- “আদিকালে যখন পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, তারকা আদি কিছুই ছিল না- ছিল কেবল ঘোর অন্ধকার। তস্তি নামক দেবতা এই বিশ্ব জগৎ সৃজন করিলেন। সর্বশেষ যখন রমণীসৃষ্টির পালা, তখন বিশ্বস্রষ্টা তস্তি দেখিলেন যে, তিনি পুরুষ সৃজন কালেই সমুদয় মাল-মসলা ব্যয় করিয়া ফেলিয়াছেন। আর ঘন শক্ত কোন অবশিষ্ট নাই। তস্তি দেব নৈরাশ্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া, উপায়ান্তর না দেখিয়া ধ্যানমগ্ন হইলেন। ধ্যান ভঙ্গের পর তস্তি দেবতা কতগুলি বিশেষ বিশেষ পদার্থের সার সংগ্রহ আরম্ভ করিলেন। যথা,…… ১. পূর্ণচন্দ্রের গোলত্ব; ২. সর্পের বক্রগতি; ৩ লতিকার তরুশাখা অবলম্বন।; ৪. তৃণের মৃদু কম্পন; ৫. গোলাপ লতার ক্ষীণতা; ৬. কুসুমের সৌকুমার্য; ৭. কিশলয়ের লঘুত্ব; ৮. হরিণের কটাক্ষ ৯. সূর্যরশ্মির ঔজ্জ্বল্য ১০. কুয়াসার অশ্রু; ১১. সমীরণের চাঞ্চল্য ১২. শশকের ভীরুতা ১৩. ময়ূরের বৃথা গর্ব; ১৪. তালচঞ্চু পক্ষীর পাখার কোমলতা; ১৫. হীরকের কাঠিন্য; ১৬. মধুর স্নিগ্ধ স্বাদ; ১৭. ব্যাঘ্রের নিষ্ঠরতা; ১৮. অনলের উত্তাপ; ১৯. তুষারের শৈত্য; ২০. ঘুঘুর কাকলী; ২১. নীলকন্ঠের কিচিরমিচির গান; ২২. তেঁতুলের অম্লত্ব; ২৩. লবণের লাবণ্য; ২৪. মরিচের ঝাল; ২৫. ইক্ষুরসের মিষ্টতা; ২৬. কুইনাইনের তিক্ততা; ২৭. যুক্তি-জ্ঞানহীনতার কুটতর্ক; ২৮. কলহ প্রিয়তার মুখরতা; ২৯. দার্শনিকের অন্যমনস্কতা; ৩০. রাজনৈতিক ভ্রান্তি; ৩১. পাষাণের সহিষ্ণুতা; ৩২. সলিলের তারল্য ৩৩. নিদ্রার মোহ(নারী সৃষ্টি, পৃ-১৭২,১৭৪)

ঐ একই দেবতা যখন পুরুষ সৃষ্টি করেন তখন বলেন- “দন্ত নির্মাণে সময় সর্পের বিষদন্ত আমূল লইয়াছি, হস্তপদ নখ প্রস্তুত করিতে শার্দুলের সমস্ত নখর লইয়াছি, মস্তিষ্কের কোষসমূহ পূর্ণ করিবার সময় গর্দভের গোটা মস্তিষ্কটাই ব্যবহার করিয়াছি। নারী সৃজন কালে আমি শুধু অনলের উত্তাপ লইয়াছি আর পুরুষের বেলায় জ্বলন্ত অঙ্গার লইয়াছি।” (সৃষ্টিতত্ত্ব, পৃ-২২৪)

একই সাথে নারী পুরুষের সামাজিক শ্রম বিভাজন প্রসঙ্গে রোকেয়া বলেন- “স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন! স্বামী যখন কল্পনা-সাহায্য সুদূর আকাশে গ্রহনক্ষত্রমালা-বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন সূর্যম-লের ঘনফল তুলাদ-ে ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাউল ডাল ওজন করেন এবং রাঁধুনীর গতি নির্ণয় করেন।“ (অর্ধাঙ্গী, পৃ-৩০)

উপরোক্ত ‘গুণে’গুনান্বিত, নারীর প্রচলিত সামাজিক-সাহিত্যিক সংজ্ঞায়ন, কাজের সীমানা নির্ধারণ ইত্যাদিকে উল্টো করে দেখিয়ে পুরুষের নির্মিত নারীর ভাবমূর্তিকে একেবারেই ভেঙে দিয়েছেন রোকেয়া। সুলতানার স্বপ্ন রচনায় বিদ্রুপাত্মকভাবে পুরুষের জায়গায় নারীকে বসিয়ে দেখিয়েছেন নারীর অবস্থানকে। নারীর পরিচয় সেখানে বিজ্ঞানমনষ্ক সেখানে নারীরা সা¤্রাজ্য পরিচালনা করেন, রাজনীতি করেন, চর্চা করেন বিজ্ঞানের, তৈরি করেন প্রকৃতিবান্ধব উদ্যান এবং জলধর বেলুন আর সূর্যতাপ সংগ্রহ যন্ত্র। ঐ রাজ্যে পুরুষরা থাকেন অন্দর মহলে আর নারীরা বাইরের কাজে। কেবল পেশী নয় মস্তিষ্ক চালনার মাধ্যমেও যে যুদ্ধে জয় লাভ করা যায় ঐ দেশের নারীকে দেখে বোঝা যায়। রোকেয়া বলেন- “আমরা শ্রম বন্টন করিয়া লইয়াছি-, তাহারা পুরুষরা শারীরিক পরিশ্রম করেন, আমরা মস্তিষ্ক চালনা করি। আমরা যে সকল যন্ত্রের উদ্ভাবন বা সৃষ্টি কল্পনা করি, তাহারা তাহা নির্মাণ করেন। নর-নারী উভয়ে একই সমাজ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ- পুরুষ শরীর, রমণী মন।“ (সুলতানার স্বপ্ন, পৃ-১৩৬)

রোকেয়া একদিকে যেমন নারীর সামাজিক পরিচয়ের অসম্মানিত দিক বিদ্রুপাত্মকভাবে দেখিয়েছেন তেমনি যুক্তি ও শক্তিশালী চিন্তা দিয়ে দেখিয়েছেন নারী কেবল অনুষঙ্গ নয়, প্রাণহীন চিন্তাহীন জড়বস্তু বরং নারী সৃষ্টিকারী। নারী-পুরুষ সৃষ্টি বিষয়ে বিদ্রুপ, সমাজ-রাষ্ট্রের নারী বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যঙ্গ যে প্রখরতা নিয়ে রোকেয়া করে গেছেন, সেই প্রখরতা কি আমাদের দেশের নারীসমাজ আজও ধারণ করতে পেরেছে?

৪.
অনেক প্রাচীন কাল থেকে আমরা শুনে আসছি নারী সকল অমঙ্গলের মূল, নারীর জন্ম আজন্ম পাপ, নারী কখনোই পুরুষের সমকক্ষ নয়! সাক্ষী ধর্মগ্রন্থ! এখন হয়তো সমাজ আর আগের জায়গায় নেই, এখন আর নারী শিশুকে মাটিতে পুতে ফেলে হত্যা করা হয় না। এখন আধুনিক প্রগতিশীল বাবা-মাও বলেন ছেলে হোক, মেয়ে হোক তাই যথেষ্ট। কিন্তু এই আধুনিক প্রগতিশীলরা সম্পত্তি ভাগাভাগির সময় অতি ধার্মিকে পরিণত হন। এসবে কান্ডারির ভূমিকা রাখেন পরিবারের পুরুষ সদস্যগণ। সম্পত্তি সম্পর্ক যখন রক্ত সম্পর্কের কাছাকাছি মানুষগুলোকে দু’পক্ষে দাঁড় করায় তখন গর্ভধারিণী মা’ও প্রায়শই পুরুষের দলে গিয়েই সামিল হন। রোকেয়ার মহিমাকীর্তন সমাজে ঠিকই চলে, কিন্তু রোকেয়ার ধারে কাছেও সমাজ পোঁছে না। সে কারণে রোকেয়াকেই আবার আমরা স্মরণ করতে চাই- “আমরা ঈশ্বর ও মাতার নিকট ভ্রাতাদের অর্ধেক নহি। তাহা হইলে এইরূপ স্বাভাবিক বন্দোবস্ত হইতে, পুত্র যেখানে দশ মাস স্থান পাইবে, দুহিতা সেখানে পাঁচ! পুত্রের জন্য যতখানি দুগ্ধ আমদানী হয়, কণ্যার জন্য অর্ধেক। সেরূপ ত নিয়ম নাই। আমরা জননীর স্নেহ-মমতা ভ্রাতার সমানই ভোগ করি মাতৃ-হৃদয়ে পক্ষপাতিতা নাই। তবে কেমন করিয়া বলিব ঈশ্বর পক্ষপাতী? তিনি কি মাতা অপেক্ষা অধিক করুণাময় নহেন? (অর্ধাঙ্গী, পৃষ্ঠা-৩৩)

যে ধর্মগ্রন্থসমূহ ধর্মীয় চিন্তার দোহাইয়ে নারীকে পুরুষতন্ত্রের বেড়াজালে পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শকে মেনে নিতে বড় ভূমিকা রাখে সেই ধর্মগ্রন্থসমূহকে রোকেয়া প্রশ্ন তোলার মতো স্পর্ধা দেখিয়েছেন। ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যায় কিছু মৌলিক জায়গায় তীক্ষ্ণ সমালোচনা ছুড়ে দেবার সাহস দেখিয়েছেন। রোকেয়ার সাহস থাকলেও সমাজের সাহস ছিল না রোকেয়ার ঐ বক্তব্যকে ধারণ করার মতো। তাই সামাজিক চাপাচাপির কারণে ১৯০৪ সালে রোকেয়া তার মূল রচনা থেকে ধর্ম বিষয়ক বক্তব্যের অংশ বাদ দিয়ে ছাপান। সেই বাদ দেয়া অংশটুকু পাঠক খেয়াল করবেন- “আমাদের যথা সম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনো মাথা তুলিতে পারি নাই; তাহার প্রধান কারণ এই বোধ হয় যে, যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। …….আমরা প্রথমতঃ যাহা সহজে মানি নাই পরে আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি……আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রস্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। কোনো বিশেষ ধর্মের নিগূঢ় মর্ম বা আধ্যাত্মিক বিষয় আমার আলোচ্য নহে। ধর্মে যে সামাজিক আইন-কানুন বিধিবদ্ধ আছে, আমি কেবল তাহারই আলোচনা করিব, সুতরাং ধার্মিকগণ নিশ্চিত থাকুন। পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভাবলে দশ জনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন, তিনিই আপনাকে দেবতা কিম্বা ঈশ্বর-প্রেরিত দূত বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এবং অসভ্য বর্বরদিগকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ক্রমে যেমন পৃথিবীর অধিবাসীদের বুদ্ধি-বিবেচনা বৃদ্ধি হইয়াছে, সেইরূপ পয়গম্বরদিগকে (অর্থাৎ ঈশ্বর-প্রেরিত মহোদয়দিগকে) এবং দেবতাদিগকেও বুদ্ধিমান হইতে বুদ্ধিতে বুদ্ধিমত্তর দেখা যায়।… তবেই দেখিতেছেন, এই ধর্মগ্রস্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুণিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোনো স্ত্রী মুণির বিধানে হয়তো তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। কিন্তু স্ত্রীলোকদের সেরূপ যোগ্যতা কই? যে, মুণি ঋষি হইতে পারিতেন? যাহা হউক, ধর্মগ্রস্থসমূহ ঈশ্বর-প্রেরিত কিনা, তাহা কেহই নিশ্চয় বলিতে পারে না। যদি ঈশ্বর কোনো দূত রমণী-শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত বোধ হয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না। দূতগণ ইউরোপে যান নাই কেন? আমেরিকা এবং সুমেরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত যাইয়া ‘রমণী জাতিকে নরের অধীন থাকিতে হইবে ঈশ্বরের এই আদেশ শুনান নাই কেন? ঈশ্বর কি কেবল এশিয়ারই ঈশ্বর? (আমাদের অবনতি, পৃ-১১)

ধর্ম যে শ্রেণী এবং লিঙ্গ প্রশ্নের সাথে হাত ধরাধরি করে পথ চলে সেই কঠিন সত্যটি সেই যুগে রোকেয়া উত্থাপন করে স্পষ্ট করবার সাহস দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এই জমানায় আজও আমরা ধর্ম প্রশ্নের মোকাবেলা স্পষ্টরূপে হাজির করতে পারি নি, শুধু তাই নয় ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র যে অঙ্গীকার করেছিল তাও পূরণ হয়নি ‘স্বাধীন ভূখন্ডে’।

৫.
সামাজিক নিয়মকে পরতে পরতে রক্ষা করে ‘নিরপরাধ’-‘নিষ্কলঙ্ক-‘পবিত্র-‘সৎ ইত্যাকার উপাধি মিলতে পারে ঠিকই, কিন্তু এর ফলে নিজ এবং বিশ্ব এদুইকে ভালোবাসার দুষ্কর তাকত-সাহস যেন নারী হারিয়ে ফেলে। রোকেয়া তাঁর লেখায় বারবার সেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। আমরা প্রায়ই ভাবি রোকেয়াকে বোধহয় আমাদের সমাজ অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা তো অন্য কথা বলে। পদ্মরাগ উপন্যাসে রোকেয়া বলেন- “আমার এ কাব্য সামাজিক নিয়ম রক্ষা হয় নাই, আমি কেবল বিশ্ব প্রেমিকের চিত্র আঁকিয়াছি”। (পদ্মরাগ, পৃ-২৮৯)

রোকেয়া সত্যকে অস্বীকার না করে, না এড়িয়ে, বাস্তবের মুখোমখি হয়ে; বিশেষভাবে মধ্যশ্রেণির এবং সাধারণভাবে সমগ্র নারীর জীবনের প্রতিদিনের নির্মম অভিজ্ঞতা, চাপা দেয়া অস্বস্তিকে সকলের সামনে যেভাবে উন্মোচন করার সাহস দেখিয়েছেন, সেই সাহস ঐ সময়ের নারী তো দূরে থাক, রোকেয়ার পূর্বসুরি কিংবা সমসাময়িক গ্রগতিশীল হিসেবে চিহ্নিত লেখক-সাহিত্যিক পুরুষরাও নিজ সুবিধা হারাবার কিংবা আক্রান্ত হবার ভয়ে দেখাতে পারেন নি। আজও প্রগতিশীল পুরুষ হিসেবে চিহ্নিতরা এসব কিছু দেখেন না বা সযতেœ এড়িয়ে যান, এমনকি নারী আন্দোলনেও এই বিষয়গুলো চেপে রাখা বিষয় হিসেবে মনোযোগের বাইরে থেকে যায়। উনিশ শতকে সমাজের নিগড়ে পুরুষতান্ত্রিকতার কারণে বঙ্কিমচন্দ্রের শঙ্কায়মান জাত-কুলকে অস্পৃশ্য রাখার মন নারীকে যেভাবে দেখেছে, ঠিক তার উল্টো কায়দায় সম্মানের জায়গা থেকে দেখেছে রোকেয়ার মন। রোকেয়ার এই অনন্যতা তাই আজও বিস্ময়কর ঠেকে।

আমরা দেখি বঙ্কিমের দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসের মূল চরিত্র প্রফুল্ল সংসারে জাতের দোহাইয়ে নানা অপমানের শিকার হয়ে ক্রমে দেবী চৌধুরাণী হয়ে উঠেন। দেবী চৌধুরাণী যখন ৫ বছর প্রশিক্ষণ নিয়ে তীক্ষè শাণিত হয়ে দলেবলে ধনী অত্যাচারিদের কাছ থেকে ধন-দৌলত ছিনিয়ে গরিব মেহনতিদের মধ্যে বিলিয়ে দেবার কাজে লিপ্ত হন, তখন আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়, মনে হয় নারী কেবল সংসার-ধর্মই নয়; সুযোগ পেলে নেতৃত্বও দিতে সক্ষম। দেবী চৌধুরাণীকে ঘিরে নারী পাঠকের ভষ্যিতের স্বপ্ন এবং সম্ভাবনা উপন্যাসের যবনিকায় চুরমার হয়ে যায়। কেননা পরিণতিতে সংসারে যাদের চরম অন্যায়-অপমানের কারণে প্রফুল্লকে ঘর ছাড়া হতে হয়েছিল- ‘দেবী চৌধুরাণী’ হতে হয়েছিল, সেই অপমানের যন্ত্রনা ভুলে গিয়ে, আত্মসম্মানকে পায়ে মাড়িয়ে, দেবী চৌধুরাণীর মৃত্যু ঘটিয়ে প্রফুল্লকে সংসারে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে আসেন বঙ্কিম। ঘরে ফিরে প্রফুল্ল উচ্চারণ করেন- “ভাল লাগিবে বলিয়াই আসিয়াছি, এই ধর্মই স্ত্রী লোকের ধর্ম, রাজত্ব স্ত্রী জাতির ধর্ম নয়। কঠিন ধর্ম এই সংসার ধর্ম, ইহার অপেক্ষা কোন যোগই কঠিন নয়।“ (বঙ্কিম ১৯৮৬, দেবী চৌধুরাণী, পৃ-৮২৪)

পক্ষান্তরে রোকেয়ার পদ্মরাগ উপন্যাসে সিদ্দিকা ওরফে জয়নাব সমাজ-সংসার-যৌতুক ইত্যাদিতে ভারাক্রান্ত হয়ে তারিণী ভবনে আশ্রয় নেন পদ্মরাগ নামে। যে ভবন বিধবার, যে বালিকার কেউ নেই তার, যে সধবা স্বামীর পাশবিক অত্যাচারে চূর্ণ-বিচূর্ণ, জরাজীর্ণ হয়ে গৃহত্যগ করতে বাধ্য হন সেসকলের আশ্রয়স্থল। তারিণী ভবনে জীবন অতিবাহিত করে হারানো স্বামী-সংসার ফিরে পাবার প্রস্তাবের সাথে কেবল আত্মমর্যাদার প্রশ্নে আপস করেনি পদ্মরাগ। স্বামীর প্রতি প্রবল প্রেমানুভূতি ও টান উপলব্ধি করেও একই সাথে প্রত্যাখ্যান করেছেন সংসার ধর্মের প্রস্তাব, আর বলেছেন- “আমি যদি উপেক্ষা লাঞ্ছনার কথা ভুলিয়া গিয়া সংসারের নিকট ধরা দেই তাহা হইলে ভবিষ্যতে এই আদর্শ দেখাইয়া দিদিমা ঠাকুমা’গণ উদীয়মনা তেজস্বিনী রমনীদের বলিবেন, “আর রাখ তোমাদের পণ ও তেজ-ঐ দেখ না জয়নব আবার স্বামীর সেবাই জীবনের সার করিয়াছিল।” আর পুরুষ-সমাজ সগর্বে বলিবেন, “নারী যতই উচ্চশিক্ষিতা, উন্নতমনা, তেজস্বিনী, মহীয়সী, গরীয়সী হউক না কেন, ঘুরিয়া ফিরিয়া আবার আমাদের পদতলে পড়িবেই পড়িবে। আমি সমাজকে দেখাতে চাই, একমাত্র বিবাহিত জীবনই নারী জন্মের চরম লক্ষ্য নহে; সংসার ধর্মই জীবনের সার ধর্ম নহে। পক্ষান্তরে আমার এই আত্মত্যাগ ভবিষ্যতে নারীজাতির কল্যাণের কারণ হইবে বলিয়া আশা করি।“ (পদ্মরাগ, পৃ-৪১৪)

বঙ্কিমের রক্ষণশীল মনোভাব না পারলেও রোকেয়া উনিশ শতকে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে যেভাবে চপেটাঘাত করার মতো সাহস দেখিয়েছেন, আজকের নারী কিংবা এমনিক নারী আন্দোলনও কি সেই শক্তি ধারণ করে? এই শক্তিকে প্রতিদিনের জীবনে যাপনে অব্যাহত রাখা জরুরত বোধ করি আমরা। এই সংগ্রামে রক্তক্ষরণের মতো যত যন্ত্রণাই তৈরি করুক কিংবা কন্টকবিহীন ফুলেল অনূভুতি তৈরি না করুক, তারপরও। সকল নিষ্ঠুর সংগ্রামসমেত জীবনকে না অগ্রসর করলে নারীর ব্যক্তিসত্তার দেখা পাওয়া ভার। নদীতে নামবো কিন্তু জলে ভেজাবো না এ ধরণের ন্যাকা এবং নিরীহ অবস্থান শান্তিপ্রিয়তা তৈরি করতে পারে কিন্তু জীবনকে সম্মান দিতে পারে না।

রোকেয়া এবং বঙ্কিমকে এইভাবে পাঠকের সাথে পরিচিত করানোতে কেউ ভাবতে পারেন আমরা ঘর ভাঙার আহ্বান করছি, মোটেই তা নয়। বরং আমরা চাই ঘর প্রসঙ্গে নতুন প্রশ্ন ও ভাবনা সামনে আনতে। যাকে আমরা ঘর বলছি তা আসলে কী? যে ঘরের মধ্যে আমরা দু’জন কিংবা দুয়ের অধিক নারী-পুরুষ রক্ত-আত্মীয়তা বা সার্টিফিকেট সম্পর্কের জোরে একসাথে এক ছাদের নিচে সহাবস্থান করি- তা কি আদতে সহ-অবস্থান? যে ঘরে আমরা সহাবস্থান করি বলে গলা ফাটাই সেখানে কি আমরা (নারী-পুরুষ) সমান অধিকার-সুযোগ, গণতান্ত্রিক সম্পর্কের চর্চা করতে পারি? নাকি কেবল অন্যের অধীন হয়ে রাত পার করি আদেশ উপদেশ মাথা পেতে নেই? একঘরে জীবন-যাপনে অভ্যন্থ হই, কখনো বাধ্য হই? নিজ ঘরে বলে যাকে আমরা আপন করি সেখানেও কি আমরা পরবাসী, পরদেশী নই? পরবাসী হিসেবে নয় বরং নিজের জন্য সেই নতুন ঘর নির্মাণের আকাক্সক্ষা কি খুব বেশি চাওয়া, যেখানে নারী-পুরুষের সমান ভাবনা, গণতান্ত্রিক সম্পর্ক বজায় থাকবে? দাস হবার চেয়ে সেই নতুন ঘর নির্মাণের আকাক্সক্ষাই রোকেয়া জাগ্রত করেছিলেন।

সমাজ-সম্পর্কের ভাঙা গড়ায়, বর্তমান জমানায় আমরা দেখি, নারী যত অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হচ্ছেন ততই নারীর নিজ অধিকার-হিস্যার বিষয়টি সামনে আসছে। আর ঘর এর সাথে সাথে ঐ ঘরের বাসিন্দাদের সম্পর্ক-জীবনবোধ ইত্যাদি বিষয় ধারণার বদল ঘটছে। প্রচলিত বৈবাহিক-পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধন বাস্তবতাকে এড়িয়ে অটুট থাকতে পারছে না। বিবাহ-বিচ্ছেদ, দেরি করে বিয়ে করা; কোনো ক্ষেত্রে বিয়ে না করা; একা সন্তানসহ ‘সিঙ্গেল মাদার’ হিসেবে জীবন অতিবাহিত করা, সন্তান না দেওয়া কিংবা ‘মুক্ত সম্পর্ক; (লিভ টুগেদার) ইত্যাকার সম্পর্কের ধরণের হার বাড়ছে। একই সাথে সম্পর্ক হাজির হচ্ছে নতুন মাত্রায় নতুন বৈচিত্র্য আর জটিলতায়। ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব ইত্যাদি শ্রেণিতে শ্রেণিতে এসবের চর্চার বা বৈশিষ্ট্যের কিছু পার্থক্য থাকলেও মর্মবস্তুর দিক থেকে এর রূপ একই। মধ্যবিত্ত নারী যে সংকট মোকাবেলা করেন, জরাজীর্ণ শ্রমিকের কুটিরেও শ্রমিক নারী সেসব সংকট থেকে মুক্ত নন। এসব বিষয়কে সমাজের সাথে নারীর জীবনবোধের লড়াই এবং ঘাত-প্রতিঘাতের প্রতিফলন হিসেবে না দেখে বরং দেখা হয় সমাজের অশনী সংকেত বা ক্ষয়ের লক্ষণ হিসেবে। আমরা কি এখনও প্রচলিত ভাবনার বাইরে গিয়ে এসবকে দেখতে শিখেছি? নারী আন্দোলন যদি শাণিত অবস্থায় থাকতো তাহলে নিশ্চিতভাবেই এই নারীরা ঘর-সংসার শুরু করার আগেই সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রেও অনেক সচেতন হতে পারতেন। একইসাথে পারতেন গণতান্ত্রিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ‘নতুন ঘর’, ‘নতুন সম্পর্ক’ নির্মাণের স্বপ্ন দেখতে এবং জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে এবং সেই জীবনের সংগ্রাম ও আয়োজন সজ্জিত করতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংকট পেরুনোর জন্য নারীর যাবতীয় লড়াইয়ের বেশিরভাগটাই ব্যক্তিগত ও স্বতঃস্ফূর্ত পর্যায়ে আটকে আছে। কেউ সংসারের চেহারা পাল্টানোর চেষ্টায় আছেন, পুরুষকে ছাড় না দিয়ে নতুন অভ্যস্ততা তৈরির চেষ্টায় আছেন। কেউ কাজের আঙ্গিনায়-অফিস আদালতে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কেউ অপমানের যন্ত্রণা ভুলতে নিজের মর্যাদা রক্ষার্থে আত্মহত্যা করেছেন। এইসব স্বতঃস্ফূর্ততাকে ব্যক্তিক সম্মানের সাথে সাথে সমগ্রের সম্মানের প্রশ্নে সংগঠিত করা প্রয়োজন। নারীর এবং সমগ্র জাতির সামষ্টিক সম্মানের প্রশ্নে রোকেয়াকে যদি আমরা যথার্থভাবে পাথেয় হিসেবে নিতে পারি, তবেই হয়তো একটা ঠিকঠাক দিশা আমরা খুঁজে পাবো।

৬.
আমাদের দেশে মূলধারা নারী আন্দোলনে রোকেয়া পুরোধা ব্যক্তি হিসেবেই স্বীকৃত। কিন্তু এই নারী আন্দোলনকেও আমরা দেখি খ-িত আকারে হাজির হতে, সমাজ-রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থানকে এড়িয়ে যেতে। কিন্তু রোকেয়ার দিকে তাকালে দেখি যে সময় রাজনৈতিক সংগ্রাম শক্ত করে জমাট বাধে নি সে সময়ও রোকেয়ার রাজনৈতিক মন, রোকেয়ার সময়ে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বাস্তবতা উপনিবেশবাদ সম্পর্কে সজাগ। ১৮৮০ সাল, ভারত তখন ব্রিটেনের উপনিবেশ, ঐ সময়ে রোকেয়ার জন্ম। রোকেয়ার কর্ম-জীবন ও তার লেখার সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটে ১৯০৪ সালের পর। রোকেয়া যখন লেখালেখি করছেন, ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ড বা উপনিবেশিত ভারতে ঐ সময়ে নতুন এক সামাজিক শিক্ষিত গোষ্ঠী ‘ভদ্দরলোক’ হিসেবে পরিচিতি হচ্ছিল। এই ভদ্দরলোক শিক্ষিতদের পাশাপাশি ব্রাহ্ম সমাজসহ, মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা স্বামীর সুযোগ্য স্ত্রী হবার বাসনা নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা-দীক্ষার সাথে যোগসূত্র ঘটান। রোকেয়া এ বিষয়ে পদ্মরাগ উপন্যাসে রাফিয়ার জীবন বর্ণনাকালে বলেন- সেই সঙ্গে তিনি (রাফিয়া) নিজে পিয়ানো, সেতার প্রভৃতি বাজাইতে এবং প্রাণপনে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা করিতে লাগিলেন। যাহাতে ইংল্যান্ড প্রত্যাগত স্বামীর উপযুক্ত ভার্যা হইতে পারেন…….স্বামীর সহিত ইংরেজিতে প্রেমালাপ করিতে পারেন। সেই উদ্দেশ্যেই এই সকল সাধনা। (পদ্মরাগ, পৃ৩৪৭)

এই ধরণের পরিস্থিতিতে ঐ সামাজিক গোষ্ঠী নিয়ে নানা তর্ক-বির্তক থাকলেও এটা স্পষ্ট যে ব্রিটিশ উপনিবেশ তার সহযোগী তৈরির লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এই অঞ্চলে শিক্ষা-দীক্ষার দিকে মনোযোগী হয়েছিল। আর তাদের মনোযোগের অন্তরালেই নানা ঘাত-প্রতিঘাত, দ্বন্দ্ব-বিরোধ গড়ে উঠতে দেখা যায়। যার প্রভাব আমরা দেখতে পাই ঐ সময়ের লেখক-সাহিত্যিক সমাজসংস্কারক-রাজনৈতিক সংগঠকদের কাজে। ‘ভদ্রলোক’ এবং তাদের সহযোগী ‘ভদ্র মহিলা’ উৎপাদনের কালে সমাজে হাতে গোনা যে ক’জনা নারী ছিলেন, যারা ছিলেন, যারা দুনিয়াকে ভিন্নভাবে দেখার ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ করার সুযোগ-সম্ভাবনা বা আকাক্সক্ষা নিয়ে হাজির ছিল, রোকেয়া তাদের মধ্যে একেবারে পুরোধা নিঃসন্দেহে। যিনি সমাজ রাষ্ট্র নারীকে একটি পাটাতনে এনে দেখবার চেষ্টা করেছেন, যিনি বিশ্বকে ভালোবাসার জন্য সামাজিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে গুটি গুটি পায়ে এগুচ্ছিলেন- যার আহ্বান ছিলো বিশ্ব প্রেমিক হবার আহ্বান, দাসত্ব মুক্তির আহ্বান। সেই রোাকেয়া তার কাজ ও লেখায় শক্তি নিয়ে যখন ঔপনিবেশিকার বিরুদ্ধে বলেন তখন সন্দেহাতীতভাবে তার শক্তি-সামর্থ্য ও ইতিহাসবোধ সম্পর্কে আমাদের ভরসা-আস্থা বৃদ্ধি পায়। আর এটাও স্পষ্ট হয় যে, নারী প্রশ্নকে গুরুত্ব সহকারে সমাজে স্থান করে দাঁড়াতে- মানুষের সামগ্রিক সংগ্রামে একাত্ম করতে- দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নারীর অবস্থান নেবার কোন বিকল্প নেই। সে কারণে রোকেয়ার নারীবাদী ভাবনায় নারী কেন্দ্রে থাকলেও তা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে বাদ দিয়ে বা ছাপিয়ে যায় নি। ফলে তার নারী ভাবনাও অনেক শক্তি ও জোর নিয়ে সমাজে আসন করতে পেরেছিল। লাল সালাম তাই রোকেয়ার প্রাপ্য।

‘নিরীহ বাঙালী’ এবং ‘জ্ঞানফল’ লেখায় রোকেয়ার স্বদেশী মনোভাব ও উপনিবেশ বিরোধী অবস্থান আমাদের চোখে ধরা দেয়। বিরাট মাপের সাহিত্যগুণের আধার হয়ে তিনি নতুন কল্পকাহিনী দিয়ে কখনো বিদ্রুপ করে কখনো খোঁচা দিয়ে তদানীন্তন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক হাল-চালে নারীকূলের বেদিশা দশার এক অসামান্য চিত্র এঁকেছেন। ইতিহাস-মিথকে আমরা যেভাবে জেনে-বুঝে আসছিলাম, অসম্ভব কল্পনাশক্তি দিয়ে আমাদের সেই পুরনো নিয়ম-রীতি-বয়ানকে উল্টেপাল্টে দেখার সাহস দেখিয়েছেন তিনি। ‘জ্ঞানফল’ নারীবাদী এবং ঔপনিবেশিকতা বিরোধী তেমনিই একটি শক্তিশালী রচনা। জ্ঞান ফলে আমরা পাই ধর্মীয় গ্রন্থের আদি পিতা-মাতার পুরাতন রূপের বদল। আদি পিতা আদমকে পথভ্রষ্ট করার দায়ে হাওয়ার শতভাগ দুর্নামের সাথে আমরা পরিচিত। রোকেয়া পাঠ ছাড়া এই ‘হতচ্ছারীর’ সাথে নতুন করে সাক্ষাৎ পাওয়া কঠিন ছিল। সেই দিক থেকে রোকেয়ার পাঠক হিসেবে নিঃসন্দেহে আমরা সৌভাগ্যবান। সৃষ্টির শুরু থেকেই যে, নারী ‘রহস্যময়ী’ এবং ‘পথভ্রষ্টকারী’ হিসেবে দুর্নাম কুড়িয়েছেন বলে আমরা জেনে আসছি, সেই হাওয়া আদমকে প্ররোচিত করেছিল নিষিদ্ধ ফল ভক্ষনে। জ্ঞান ফলে সেই নিষিদ্ধ ফল গন্ধমকে আমরা পাই জ্ঞান চক্ষু উন্মোচনের বটিকা হিসেবে। একইসাথে ঐ সময় ভারতবর্ষে উপনিবেশ পরিচয় করিয়ে রোকেয়া গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান নেন।

উপনিবেশ, পুরুষতন্ত্র ও ধর্মপ্রশ্নের পাশাপাশি জাতীয় সম্পদ এবং শ্রেণি প্রশ্নকেও রোকেয়া যুক্ত করেছেন চাষার দুঃখ এবং এন্ডিশিল্প লেখার মধ্য দিয়ে। কোনো কালেই যে চাষা মজুরদের ‘গোলাভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু’ ছিল না, বরং চরম দুর্দশার মধ্যে তারা দিনাতিপাত করেছেন সেই দিক তুলে ধরতে রোকেয়া ভোলেন নি। তেমনি রীতিমতো অংক কষিয়ে দেখিয়েছিলেন কীভাবে এন্ডিশিল্প ধরে রাখলে আমরা লাভবান হবো।

রোকেয়া যে সমাজকে প্রশ্ন করেছেন তা সমাজকে কেবল অস্বীকার করার জন্য নয় বরং সমাজ উপলব্ধি করে ধীরে ধীরে সমাজের ভেতরে ভেতরে মানুষের সমাজ নির্মাণের কাজ করার জন্য। তাঁর লেখার বিষয় এবং ধারাবাহিকতা দেখে বোঝা যায় তিনি সমাজ বিষয়ে কতটা বিবেচক ছিলেন। তিনি যখন স্ত্রী জাতির অবনতি, জ্ঞানফল, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ উপন্যাসের মতো তীক্ষ্ণ শক্তিশালী নারীবাদী লেখা লিখেছেন- একই সময়ে সমাজের নারীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে তার অন্যান্য লেখার মধ্য দিয়ে। খুব তুচ্ছ বিষয় থেকে স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও তিনি লিখেছেন। তিনি সমাজের যে নারী যে জায়গায় আছে সেই জায়গা থেকে মুক্তির পথ দেখাতে চেয়েছেন, গৃহিনীকে সুগৃহিণী হওয়ার কথা বলে মূলত গুরুত্বপূর্ণ নারী প্রশ্ন হাজির করেন। অর্ধাঙ্গী, শিশুপালন, রসনা পূজা, ইসলাম, মহরম ইত্যাদি লেখার মধ্য দিয়ে বিদ্যমান চৈতন্যকে তিনি নাড়া দিয়েছেন। রোকেয়ার লেখার বিষয় এবং ধার এমনই ছিল যে তা তাঁকে কাছে টেনেছে একেবার জবুথবু ঘোমটা দেয়া ঘরকুনো গৃহিনী একইসাথে বিলেতফেরত আধুনিক স্বামীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যস্ত স্ত্রীর কাছেও। এইখানে এসে সংগঠক ও নেতৃত্ব হিসেবে রোকেয়ার অসামান্য ক্ষমতা আমাদের নজরে আসে।

নারী প্রশ্ন নিয়ে কেবল লেখার মধ্যেই রোকেয়া আটকে থাকেন নি। লেখা ছিল তাঁর বাস্তব পরিবর্তন সাধনের হাতিয়ার। সে কারণে বাস্তবের পরিবর্তন ছিল তাঁর কর্মতৎপরতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। লেখালেখির পাশাপাশি রোকেয়া মেয়েদের জন্য ১৯১১ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল এবং ১৯১৬ সালে মেয়েদের সামাজিক কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান ‘আঞ্জুমান ই খাওয়াতি-ই-ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। পদ্মরাগ উপন্যাসে তিনি নারীদের জন্য যে ‘বালিকা বিদ্যালয়’ বিধবা আশ্রম, ‘আতুর আশ্রম’ নারী ক্লেশ নিরাবণী সমিতি’র গঠন বিষয়ে উল্লেখ করেন তাতে করে তার চিন্তার রাজনৈতিক সাংগঠনিক রূপের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাস্তবে স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেও রোকেয়া তারিণী ভবন তৈরি করে যেতে পারেন নি। কিন্তু তারিণী ভবন তৈরির কল্পনা যেভাবে হাজির করেছেন তাতে তার নিজ আত্ম উপলব্ধি এবং অন্য নারীদের সাথে গভীর সম্পর্কের একটা আঁচ পাওয়া যায়। আঁচ পাওয়া যায় তার সাংগঠনিক বোধের। এখনো আমাদের দেশে নারীরা যখন গুমরে মরেন, যখন ঘর সংসারের হাত থেকে রেহাই পেতে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে চান, তারাও মনে মনে তারিণী ভবন খোঁজেন। এমন ভবন যেখানে তাদের সামাজিক দায়ের আর প্রশ্নবানের ভয় থাকবে না। আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুদের অহেতুক কৌতূহল ও কটু কথা থাকবে না। যেখানে পরিবারে পুরুষ সদস্যের সাহচার্য না থাকলেও একটা নিজের ঘর থাকবে, যেখানে নিজের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা যাবে। এমন জায়গা যেখানে চাইলে কোন মা সন্তানকে রেখে নিশ্চিন্তে ঘুরতে যেতে পারবেন। কিংবা উনুনে কি পুড়ছে এই চিন্তা না করেই মন দিয়ে উপন্যাস কিংবা তত্ত্ব পড়তে বা রচনা করতে পারবেন। নারীর ভেতরের আকাক্সক্ষাকে দূরদর্শী রোকেয়া এভাবেই পাঠ করতে পেরেছিলেন। আমাদের সমাজের নারীরা এবং নারী আন্দোলন যদি এর ধারে কাছেও পোঁছতো, তাহলে বোধ হয় ভিন্ন কোন ইতিহাসে আমরা পা বাড়াতে পারতাম।

৭.
শেষমেষ প্রশ্ন হলো এই যে সামাজিক আয়োজনে নারীমূর্তি অঙ্কিত হয় এবং আমাদের ঘাড়ে চেপে থাকে, সেই ভূত মূর্তি কী কেবলই চড়-থাপ্পড় মেরে নিপীড়ন-নির্যাতন করে আমাদের ওপর চেপে আছে না কী আমরা মনের গহীনে এই মূর্তির আসন অটুট করে চলেছি প্রতিনিয়ত। আমরা যদি নাই মানি তবে তা অটুট আছে কী কায়দায়? রোকেয়া দেখিয়েছেন সামাজিক-ধর্মীয় শিক্ষাসহ রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাই নানা মোড়কে আমাদের চিন্তা-মন জুড়ে এমন অবস্থায় আছে যে কারণে আমরা নারীরা নিজেকে নির্মাতা, সৃষ্টিকারী না ভেবে উৎসাহদাত্রী হিসেবে নিজেদের পরিচয় বহন করে চলি। নারীর এ সকল হেয়, ছোট অবস্থান এর মাঝে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের নারীরাও খাবি খাচ্ছেন। রোকেয়া সেই দিকগুলোকে উন্মোচন করেছেন এবং একইসাথে এ থেকে বের হবার আহ্বান করেছেন তার লেখা ও কাজের মধ্য দিয়ে। ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ রচনা যেন ঐ সময়ে নারী মুক্তির ঘোষণাপত্র আকারে আমাদের সামনে হাজির হয়। রোকেয়া নারীদের প্রতি আহবান করেন- “প্রথমেই জাগিয়া উঠা সহজ নহে, জানি; সমাজ মহাগোলযোগ বাধাইবে জানি; ভারতবাসী মুসলমান আমাদের জন্য “কৎল”-এর (অর্থাৎ প্রাণদন্ডের) বিধান দিবেন এবং হিন্দু চিতানল বা তুষানলের ব্যবস্থা দিবেন, জানি!!…….. (এবং ভগ্নীদিগেরও জাগিবার ইচ্ছা নাই, জানি!) কিন্তু সমাজের কল্যাণের নিমিত্ত জাগিতে হইবেই।“ (স্ত্রীজাতির অবনতি, পৃ-২০)

আমিসহ আমার মতো হাজারো নারীর জীবনকে বড় রকম ঝাঁকি দিতে বিদ্যমান ভাবনার শেকড় ধরে টান দিতে রোকেয়া কতটা পারঙ্গম ছিলেন তা লিখে জানানে বোঝানোর সাধ্য আমার সীমিত। এই সীমিত চেষ্টা যদি রোকেয়াকে নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে এবং প্রতিদিনের একঘেয়ে জীবন বিষয়ে প্রশ্ন করতে কিছুটা উস্কে দেয় তাতেই আমরা ধন্য। আমরা আশা করি রোকেয়ার নারীবাদী পরিচিতি আমাদের নারী মুক্তির আন্দোলনকে নতুন রূপে সজ্জিত করতে সাহায্য করবে।

গ্রন্থসূত্র
১. রোকেয়া, রোকেয়া রচনাবলী, বাংলা একাডেমী ১৯৮৪।
২. বঙ্কিমচন্দ চট্রাপাধ্যায়, দেবী চৌধুরাণী, বঙ্কিম রচনাবলি, তুলিকলম, কলকাতা ১৯৮৬।

লেখকঃ তাসলিমা আখ্তার
সহ সভাপতি, নারী সংহতি,
সভাপ্রধান গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি
সদস্য, রাজনৈতিক পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন এবং আলোকচিত্রী।

Leave a Reply