You are currently viewing গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা

গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা

( সম্পাদকীয় নোট: আজীবন সংগ্রামী রাজনিতিবিদ অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম রাজশাহীতে অষ্টম শ্রেনীতে পড়ার সময়ই ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন। মাত্র ১৭(?) বছর বয়সে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, মাইতি গ্রুপের সদস্য হিসেবে। স্বাধীন দেশের মানুষের জন্য পরবর্তী সময়েও তিনি আজীবন মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত থেকেছেন, মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি সংবিধান প্রশ্নটিকে কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা ‘ লেখাটি ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ তারিখে NTV online এ প্রকাশিত হয়। )

আসছে ফেব্রুয়ারি মাসে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগের প্রশ্নটি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে চলছে বিভিন্ন পর্যালোচনা, সমালোচনা ও পর্যবেক্ষণ। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ও ভূমিকা পালনের নিয়ম, বিধি, আইনকানুন এবং কমিশনের আওতা বা ক্ষমতা প্রয়োগের বিধান সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত আছে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বেশ কিছু বিষয় পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

কোনো জাতীয় নির্বাচনই অংশগ্রহণকারী সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কেউ না কেউ সেসব প্রত্যাখ্যান করেছে। বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দলকে দেখা গেছে নির্বাচনের ফল বর্জন করে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে। এ নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা অচলাবস্থার অবসান হয়নি। সামনের দিনেও এর আশঙ্কা কম থাকবে বলে মনে হয় না।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব নাগরিকের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্বে থাকে নির্বাচন কমিশন। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন চলাকালে কমিশনের ভূমিকা তখনই গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিযুক্ত হবে, যখন কমিশন অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রভাবমুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব প্রতিপালন করতে সক্ষম হবে। এ ছাড়া কমিশনকে অতি অবশ্যই রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠান থেকে প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে। এসব বিষয়ে সাংবিধানিক নিশ্চয়তাও অপরিহার্য।

বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন-স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে দেওয়ার বিধান সাংবিধানিকভাবে থাকলেও এর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এ কারণে সবার অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, কারচুপিবিহীন, এবং দুর্নীতি ও কালো টাকার প্রভাবমুক্ত কোনো সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান নির্বাচন-সংক্রান্ত রাজনৈতিক বাস্তবতা এর প্রমাণ।

বাংলাদেশের বর্তমান শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতার চর্চা যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, এর পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন কমিশনের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই। চলমান বিতর্কের মূল বিষয়বস্তু হলো নতুন নির্বাচন কমিশন। এটি এমন হতে হবে, যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য, প্রকৃতই স্বাধীন এবং নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে সক্ষম। এ জন্য একজন যোগ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ নিশ্চিত করাও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।

দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধি এসব নিয়ে নানা মত ও পরামর্শ দিচ্ছেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্প্রতি [১৮ নভেম্বর ২০১৬] একটি সৎ, সাহসী, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এটির সারকথা হলো, নবগঠিতব্য কমিশন বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য হলেই নির্বাচন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হবে। আর যদি মনমতো কমিশন হয়, হবে সেটির অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণে দলটির কোনো আপত্তি থাকবে না। অন্যদিকে সুশীল সমাজের বক্তব্য হলো কমিশন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য হলেই সেটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, সংবিধানের ১১৮ ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠিত হলেই নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে এবং আওয়ামী লীগ তাই চায়। বলে রাখা ভালো, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এই একই ভাষায় সংবিধানের ওই বিধানকে উল্লেখ করেছিল। এতে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক জারি আছে এবং থাকবে।

অবশ্য সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের প্রস্তাব হলো নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ লাভের আগে একজন ব্যক্তির যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণের সুবিধার্থে একটি আইন প্রণয়ন করা হোক। বর্তমান সংবিধানেও এরূপ একটি আইন প্রণয়নের বিধান আছে। যদিও আজ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন কোনো দলই অমন আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হয়নি। হয়তো দলগুলো ভয় পায় যে এতে তাদের ক্ষমতার পরিধি সংকুচিত হয়ে পড়বে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কিন্তু তাঁর প্রস্তাবে এ ধরনের আইন প্রণয়নের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।

কমিশন ও কমিশনাররা দেশের প্রধান দুই দল বা নির্বাচনী জোটের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেই নির্বাচন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একমত হয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করলেই কি জনগণের সার্বভৌম ভোটাধিকার রক্ষিত হবে? না, সে নিশ্চয়তাও কার্যত নেই। কেননা, নির্বাচন-সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন এবং সংবিধানে এ-সম্পর্কিত বিধিবিধানগুলো বলবৎ রেখে সার্বভৌম ভোটাধিকার নিশ্চিতের কোনো সুযোগ নেই।

কারণ, বর্তমান সংবিধানের অধীনে প্রণীত ও জারি করা Representation of the People Order 1972-এর অধিকতর সংশোধনীতে (যা ২০০৮ সালের ৪২ নম্বর অধ্যাদেশ নামে পরিচিত) নাগরিকদের এ অধিকার কার্যত বাতিল করা হয়েছে। আইনটির মাধ্যমে নাগরিকদের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন এবং নিজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার যে মৌলিক, জন্মগত, অলঙ্ঘনীয় ও গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে, তা রুদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ নাগরিকরা হারিয়েছে তাদের সার্বভৌম ভোটাধিকার।

আইনটিতে বিধান করা হয়েছে, কোনো নাগরিক যদি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চান, তবে তাঁকে দুটি প্রধান শর্ত পূরণ করতে হবে। একটি হলো তাঁকে অতি অবশ্যই কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে হবে এবং সেই দলের মনোনীত হতে হবে। এখানে নাগরিকদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ শর্তযুক্ত করে তাদের নির্বাচিত হওয়ার অলঙ্ঘনীয়-গণতান্ত্রিক অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। যদিও নির্বাচন কমিশন ও রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো নাগরিকদের নির্বাচিত হওয়ার ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ নিশ্চিত করা, তবুও এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিজে উদ্যোগী হয়ে জনগণের ওই অধিকারকে অস্বীকার করছে।

অন্য একটি শর্ত হলো : কোনো নাগরিক যদি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে চান, তবে তাকে অতি অবশ্যই নিজ নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটের শতকরা এক ভাগ ভোটারের অগ্রীম সম্মতি স্বাক্ষর দিতে হবে। এখানেও নাগরিকদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অলঙ্ঘনীয় অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে। নাগরিকরা কাকে ভোট দেবে, তা তাদের নিজ বিবেচনার এবং গোপন বিষয় ভোটারদের ভোটের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা সংবিধানে প্রদান করা হয়েছে তার বিরোধী। এখানেও সংবিধানকে অমান্য করা হয়েছে, যা সংবিধানের পরিপন্থী। এসব বিষয়ে ‘সুশীল সমাজের’ প্রতিনিধিদের কোনো বক্তব্য না থাকাটাও রহস্যজনক।

সংবিধানের এসব অগণতান্ত্রিক অবস্থা জারি রেখে নাগরিকদের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ নেই বললেই চলে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার গণতান্ত্রিক অধিকারকে নানাভাবে সংকুচিত করার প্রয়াস দেখা যাবে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইনের বিভিন্ন ধারা, উপধারা বিশ্লেষণ করলে। ‘আইনের চোখে সবাই সমান’—এ নীতিকে বাতিল করে শুধু ধনবান, কালো টাকার মালিকদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে রচিত হয়েছে নির্বাচনী বিধান। নির্বাচনী ব্যয়ের নির্ধারিত সীমা এর প্রমাণ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পূর্বশর্ত হিসেবে জামানতের যে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে, তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখে না। অর্থাৎ নির্বাচনে সাধারণ নাগরিকদের নয়, বরং কেবল ধনীদের একচেটিয়া অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

অথচ বৈষম্যপূর্ণ এ ব্যবস্থাই সংবিধানসম্মত। এ ছাড়া আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে জনগণের বিনা ভোটে, বিনা সম্মতিতে, নির্বাচন ছাড়াই সংসদ ও মন্ত্রিসভা গঠন করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা যেতে পারে। এবং তা হতে পারে সাংবিধানিকভাবেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এভাবে সংবিধানসিদ্ধ উপায়েই রাষ্ট্রের ওপরে এক দলীয়, গোষ্ঠীগত ও স্বেচ্ছাচারী শাসন চাপিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা আছে। তাই শাসনতন্ত্রের বা সংবিধানের সুনির্দিষ্ট সংশোধন ছাড়া জনগণের সার্বভৌম ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

তা ছাড়া রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের যে বিধিবিধান জারি করা হয়েছে, সেটিও চরম অগণতান্ত্রিক। অসৎ উদ্দেশ্যে সাধনে এটি ব্যবহার করে কোনো নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থকে যেমন রক্ষা করা সম্ভব, তেমনি অপর দল বা গোষ্ঠীকে বিপর্যস্ত করাও অসম্ভব নয়। এভাবে সাধারণ নাগরিকদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকারকে শর্তযুক্ত করে কায়েমি স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা সংবিধানে উল্লেখিত গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী।

বাংলাদেশের সংবিধানের অগণতান্ত্রিক চরিত্রের কারণে এখানে কখনোই জাতীয় সংসদ কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকশিত হয়নি। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা সংসদে স্বাধীনভাবে নিজ মতামত প্রকাশের ও তার পক্ষে ভোটদানের অধিকার রাখেন না। উপরন্তু সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে। এ কারণে সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয় না। এ সুযোগে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হয়ে ব্যক্তিতন্ত্র, দলতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও লুটপাটতন্ত্র বিকশিত হয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেশের সব দলই ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছে।

এ কারণে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত বেড়ে গিয়ে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র নিপীড়নকারী, অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারী এক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। ক্রমে এ রাষ্ট্রব্যবস্থা নিজকে দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থবিরোধী-নিপীড়নকারী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। শাসকশ্রেণির প্রতিটি দল, সংসদ, বিচার বিভাগ এবং সামরিক বাহিনী, পুলিশ, র‌্যাবসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সময়ে, নানাভাবে সংবিধান ভঙ্গ করে আসছে। সংবিধান নিজে নিজকে আর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে জারি রাখতে পারছে না। স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং অবাধে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ না থাকায় সংসদ নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। এতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করাটাই এক বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

গত ৪০ বছর এ দেশে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো কখনোই ব্যাপক দুর্নীতি, ভোট কারচুপি, অস্ত্র ও ক্ষমতার ব্যবহার, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখানো, ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া, ফল পাল্টে দেওয়া ও ভোটারবিহীন নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণার মতো নেতিবাচক বিষয় থেকে মুক্ত ছিল না। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সাংবিধানিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব পালনে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।

জনগণের স্বাধীন ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হলে সংবিধানের সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করতে হবে এবং তা পরিবর্তনের পথ অনুসরণ করতে হবে। একটি গ্রহণযোগ্য, কারচুপিহীন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বর্তমানে সংবিধানে বিধিবদ্ধ নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ ও অপসারণ, নির্বাচনী বিধিবিধান, নির্বাচন বিরোধ মীমাংসার পদ্ধতি, ভোটদান পদ্ধতি ও ফলাফল নির্ধারণের পদ্ধতি পরিবর্তনের আবশ্যিকতাকে স্বীকার করতে হবে। এসব বিষয়ে সাংবিধানিক পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতিতে নির্বাচন সর্বজনস্বীকৃত নির্বাচন হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না। এর প্রধান প্রমাণ বর্তমানে নির্বাচন কোনো সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে এই বিতর্কের গভীরে অনুসন্ধান করলেই বোঝা যাবে। তত্ত্ববাবধায়ক সরকার, দলীয় সরকার অথবা অন্য কোনো নামের সরকার হোক-না-কেন, তার মাধ্যমে এখনকার সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে সর্বপ্রথম দরকার নির্বাচন কমিশন নিয়োগের বিধান পরিবর্তন করে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন, স্বতন্ত্র, সত্তা ও কর্তৃত্ব নিশ্চিতে নতুন বিধান করা। সে বিধানের মূল শর্ত হবে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ ও অপসারণ সংসদের অনুমোদনক্রমে হতে হবে। এটা নিশ্চিত করার জন্য দলীয় পার্লামেন্টের ভূমিকার পরিবর্তন করে পার্লামেন্ট অবশ্যই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকার বিধান নিশ্চিত করতে হবে, এখন যা নেই।

* বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে যে একক-সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভাকে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকার ও জবাবদিহি করার বিধান চালু করতে হবে।

* সংবিধানের ৭০ ধারা বাতিল করে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন সত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

* নির্বাচন কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগদানের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি অনুসন্ধানে একটি সাংবিধানিক কমিটি নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কমিটি যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে সংসদে পেশ করবে। সংসদের অনুমোদন সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি কমিশনারদের নিয়োগ করবেন।

* নির্বাচন কমিশনকে স্বতন্ত্র সত্তাবিশিষ্ট সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে জাতীয় বাজেটে তার জন্য পৃথক বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। নিজস্ব জনবল ও কাঠামো থাকতে হবে। এ সংক্রান্ত বিধিবিধান থাকতে হবে।

* নির্বাচন কমিশনকে অতি অবশ্যই জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকার ও জবাবদিহির করার বিধান সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

* নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন করতে হবে।

* প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থা ও পদ্ধতির পরিবর্তন করে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার সব ভোটারের ভোটাধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করে ফল ঘোষণার পদ্ধতি বের করতে হবে; সমানুপাতিক/সংখ্যানুপাতিক হারে আসন বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ভোটারদের তার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রত্যাহারের বিধান করতে হবে।

* নির্বাচনী বিরোধ মীমাংসা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির দায়িত্ব সিভিল কোর্টকে প্রদান করে বিধিবিধান প্রণয়ন করতে হবে।

* স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার অগণতান্ত্রিক বিধান বাতিল করতে হবে।

* রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের অগণতান্ত্রিক বিধান বাতিল করতে হবে।

* নির্বাচনে পরিচিত ও চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, যুদ্ধাপরাধী, জাতীয় সম্পদ পাচারকারী, কালো টাকার মালিক, চোরাচালানি, মজুদদার, কালোবাজারি ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী সব চুক্তি সম্পাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎকারী ও বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধে অপরাধকারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে বিধি প্রণয়ন করে তা কার্যকর করতে হবে। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।

* অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ব্যক্তি অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার পর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, উচ্চ আদালতের বিচারপতিসহ সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা অবসরের পর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না এমন বিধান করতে হবে।

* নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনকালীন ও পরে প্রমাণিত অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচন আংশিক বা সম্পূর্ণ স্থগিত, প্রার্থিতা বাতিল ইত্যাদি ক্ষমতা ভোগ করার বিধিবিধান থাকতে হবে।

* নির্বাচন কমিশন নিখরচায় প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা নিশ্চিত করবেন।

এসব শর্ত বাস্তবায়িত হলেই কেবল একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও কার্যকর নির্বাচন আয়োজন সম্ভব।

Leave a Reply