You are currently viewing মুক্তির অমলিন আকাঙ্ক্ষা: ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র একটি পাঠ

মুক্তির অমলিন আকাঙ্ক্ষা: ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র একটি পাঠ

১. স্বাধীনতার স্পর্শগুনের তুল্য আর কী থাকতে পারে!

স্বাধীনতার কল্পনা এমন এক শক্তি, যার জন্য মানুষ প্রিয়তম জীবন উৎসর্গ করে অকাতরে। যুদ্ধের উন্মাদ ক্রোধের সময়টুকুতে শুধু নয়, মুক্তির বোধ নতুন সমাজের মানুষগুলোকেও এতটা বদলে দিতে পারে যে প্রাত্যহিক দুঃখ-সুখ ভুলে ব্যক্তিমানুষ উচ্চতর কোন সামষ্টিক সাধনায় মগ্ন হয়।  কোন অর্থনীতির মানদণ্ডের সাধ্য নেই এই মগ্নতাকে অর্থমূল্যে নির্ধারণ করে। জনগণের ভেতর থেকে এমন সব উদ্যোগ দেখা যায়, আগে যা হতো কল্পনাতীত, নিদেনপক্ষে তা অর্জনের জন্য বিশাল সব বরাদ্দ রাখতে হতো বার্ষিক রাষ্ট্রীক পরিকল্পনায়। স্বাধীন দেশগুলোতে সামষ্টিক উদ্যোগের জোয়ারের স্রোতে ভেসে যায় শত কিংবা সহস্র বছরের গ্লানি, কুআচার আর প্রতিবন্ধকতার বন্ধনজাল; সমাজদেহ থেকে উপড়ে পড়ে সব আগাছা আর পরগাছা। এক লহমায় সমাজ যতদূর আগায়, অযুত নিযুত বছরেরও সেইটুকু অগ্রগতি হয়তো সম্ভব হতো না। স্বৈরতন্ত্রমুক্ত এথেন্স সম্পর্কে হেরোডোটাস যেমন বলেছিলেন,

“এথেন্স এর আগেও ছিল মহান, কিন্তু স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্ত হবার পর হয়ে ক্রমশঃ হয়ে উঠলো মহত্তর… এভাবে এথেনীয়রা শক্তিমান হয়ে উঠলো; আর কেবল কোন একটা দৃষ্টান্ত থেকে না বরং সকল দিক দিয়েই দেখা যাবে সাম্য একটা অসাধারণ কিছু, এথেনীয়রা যখন স্বৈরতন্ত্রী-শাসিত ছিল, যুদ্ধে তাদের কোনো প্রতিবেশীর চাইতেই শ্রেষ্ঠতর ছিল না, কিন্তু স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্ত হবার পর তারাই হলো সবার সেরা। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় তাদের যখন দাবিয়ে রাখা হয়েছিল ততদিন তারা ইচ্ছে করেই শৈথিল্য দেখাতো, কেননা তারা কাজ করতো একজন প্রভূর জন্য, আর তারা স্বাধীন হবার পর প্রত্যেকেই নিজের জন্য কিছু অর্জন করতে উদগ্রীব হয়ে উঠলো।”    

আর এই অর্জনের পথটি নিত্যনতুন যে সৃজনশীলতার দরোজা খুলে দিলো তারই পরিণতিতে মহাপরাক্রমশালী পারসিক কিংবা অপরাজেয় স্পার্টান সৈন্যদের বিরুদ্ধে রনক্ষেত্রে কিংবা প্রকৃতি বিজ্ঞান আর দর্শনের তর্কক্ষেত্রে, এথেনীয়দের তুলনা বিরল। গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোতে স্বৈরাচার আর আত্মকেন্দ্রিক ক্ষমতা সর্বদাই নিজদেশে জনসমর্থনের অভাবে বিদেশী প্রভূদের কৃপা প্রার্থনা করেছে, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে বিদেশী স্বার্থের পদতলে; জনতার স্বাধীনতার অর্গল খুলে যাওয়া নগরগুলোতে কিন্তু জনতার সাধ্যের অতিরিক্ত সব অর্জনের দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় যুক্ত হয়েছে।

২.   স্বাধীনতার ঠিক বিপরীত হলো পরাধীনের গ্লানি। আত্মজ্ঞান আর মর্যাদার বোধ জাতিগতভাবেই ক্ষয়ে আসে বিজিতের, সৌন্দর্য আর পরিচ্ছন্নতার জ্ঞানও। তার সকল মহিমা যে বিজয়ীরা ধ্বংস করে, তারাই আবার তাকে চিত্রিতও করে এমনই ভাষায় যেন তারা প্রকৃতিগতভাবেই হীন, নোংরা আর উদ্যমহীন। যেমন পরাজিত আইরিশদের ওপর চেপে বসা বৃটিশরা সেটিকে পরিনত করেছিল তাদের আদিতম উপনিবেশে, রক্ত আর ঘামে ভেজা আইরিশদের শস্যদানায় ক্রমশঃ ঝকমকে হয়ে উঠেছিল ‘য়্যাবসেন্টি’ নামে পরিচিত অনুপস্থিত ইংরেজ জমিদারদের অভিজাত্যের জেল্লা, সেই ইংল্যান্ডেরই একজন দরবারী ইতিহাসবিদ লর্ড ম্যাকওলে আইরিশ চাষীদের বর্ণনা করছেন তার ইংল্যান্ডের ইতিহাস গ্রন্থে :

“অন্যদিকে আদিবাসী চাষীকূল ছিল প্রায় বর্বর দশায়। তারা এমন বন্দোবস্তেও খুশি থাকতো যেটা সুখীতর দেশগুলোতে গৃহপালিত গবাদিপশুর জন্য বরাদ্দ করা পরিস্থিতির চেয়েও খারাপ। ইতিমধ্যেই আলু নামের একটা শেকড় সাধারণ মানুষের খাদ্যে পরিণত হয়েছে, এটা কোন নৈপুন্য, পরিশ্রম কিংবা পুঁজি ছাড়াই আবাদ করা যায়, আর এটাকে দীর্ঘকাল সংরক্ষণও করা যায় না। এভাবে পেট ভরানো মানুষদের কাছ থেকে শ্রমনিষ্ঠা আর ভবিষ্যৎ-ভাবনা আশা করা যায় না। এমনকি ডাবলিনের কয়েক মাইলের মধ্যে পৃথিবীর সবচে উর্বর আর সবুজতম ভূমিতে পর্যটকরা বিবমিষার সাথে সেই অবর্ণনীয় কুড়েগুলো পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে দেখতেন ভেতর থেকে নোংরা আর আর্ধনগ্ন বর্বররা তার দিকে বুনো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।”

একই গ্রন্থে আরও বর্ণনা:

“এই অধীনতা সন্তোষের ফলাফল না, বরং স্রেফ বিস্মৃতি আর ভগ্ন হৃদয়ের ফল। অস্ত্রাঘাত তাদের আত্মার গভীরে প্রবেশ করে গিয়েছিল। অতীত পরাজয়গুলোর স্মৃতি এবং প্রাত্যহিক বিদ্রুপ আর পীড়ন সয়ে যাওয়ার অভ্যাস এই অসুখী জাতির স্পৃহাকে বশীভূতত করে ফেলেছে। বিশাল যোগ্যতা, শক্তিমতা আর উচ্চাভিলাষ সম্পন্ন আইরিশ রোমান ক্যাথলিক ব্যক্তিত্বরা কিন্তু ছিলেন:  কিন্তু কেবল আয়ারল্যান্ড ছাড়া সর্বত্রই তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে… স্বদেশে থেকে গেলে কীর্তিমাখা স্মৃতি-অমৃতসুধা পানরত অশিক্ষিত আর অকর্মন্য বাবুসম্প্রদায় হয়তো তাকেও নিজেদের তুলনায় হীনতারই ভাবতো।”

চিন্তাশীল পাঠক না বুঝে নিয়ে পারেন না, পরদেশে কীর্তিমানটির ব্যক্তিগত বিকাশ হয়তো হলো, কিন্তু জাতীয় মুক্তির রসায়নটা না ঘটায় আরও অজস্র অগণন সৃজনী শক্তি পরাধীন স্বদেশে নিত্য নিহতই হয়।

.   জাতীয় মুক্তির ছোঁয়া সমাজকে কতটা গভীর থেকে বদলে দিতে পারে, তার একটা নমুনা পাওয়া যাবে শেখ মুজিবুর রহমান এর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থটিতে, তার গণচীন ভ্রমণসংক্রান্ত অংশে। একইসাথে আশাভঙ্গের বেদনাও যে সমাজের পাপগুলোকে আরও গভীরে প্রোথিত করতে পারে, তারও আদর্শ উদাহরণ একই গ্রন্থের পাকিস্তানের রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের কারাগারে বসে যখন স্মৃতিকথাটি লিখছেন শেখ মুজিবুর রহমান, তখনও তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটি থেকে মাত্র বছর দুয়েক দূরে; পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারই একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উৎসাহী কর্মী ছিলেন তিনি। তাঁর মননে পাকিস্তান আর ভারতেরও দু’বছর পর ১৯৪৯ সালে স্বাধীন হওয়া চীনভ্রমনের অভিঘাতটি মূল্যবান:

“আমি ট্রেনের ভিতর ঘুরতে শুরু করলাম। ট্রেনে এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত যাওয়া যায়। নতুন চীনের লোকের চেহারা দেখতে চাই। ‘আফিং’ খাওয়া জাত যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। আফিং এখন আর কেউ খায় না, আর ঝিমিয়েও পড়ে না। মনে হল, এ এক নতুন দেশ, নতুন মানুষ। এদের মনে আশা এসেছে, হতাশা আর নাই। তারা আজ স্বাধীন হয়েছে, দেশের সকল কিছুই আজ জনগণের। ভাবলাম, তিন বছরের মধ্যে এত বড় আলোড়ন এরা কি করে করল!”

একদা যে হর্ম্যপ্রাসাদ ছিল বিশেষের সম্পত্তি, বাকিদের জন্য ‘নিষিদ্ধ নগরী’, সেখানে তিনি দেখছেন

এখন সকলের জন্য এর দরজা খোলা, শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। হাজার হাজার লোক আসছে, যাচ্ছে। দেখলাম রাজ-রাজড়ার কাণ্ড সব দেশেই একই রকম ছিল। জনগণের টাকা তাদের আরাম আয়েশের জন্য ব্যয় করতেন, কোনো বাধা ছিল না।“

স্বাধীনতার পর ভারত আর পাকিস্তান উভয়টিই পরিণত হয় কালোবাজারী আর ফাটকাবাজারির স্বর্গে। কারণটা খুব পরিস্কার, নতুন ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া স্থানীয় পুঁজিপতিরা এইভাবেই জনগণকে লুণ্ঠন করাটাকেই তাদের প্রাথমিক পুঁজিটুকু সঞ্চয়ের প্রধান উপায় করেছিল। চীনের ব্যতিক্রমী উদাহরণ তাই তাঁর কাছে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত মনে হয়েছে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত তাদের জানালেন,

“কালোবাজার বন্ধ। জনগণ কাজ পাচ্ছে, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ হয়ে গেছে। কঠোর হাতে নতুন সরকার এইসব দমন করেছে। যে কোন জিনিস কিনতে যান, এক দাম।… আমি একাকী বাজারে সামান্য জিনিসপত্র কিনেছি। দাম লেখা আছে। কোনো দরকষাকষি নাই। রিকশায় চড়েছি। কথা বুঝতে পারি না। চীনা টাকা যাকে ‘ইয়েন’ বলে, হাতে করে বলেছি, ‘ভাড়া নিয়ে যাও কত নেবা।‘ তবে যা ভাড়া তাই নিয়েছে, একটুও বেশি নেয় নাই। ”

শোভাযাত্রার বর্ণনাতেও জাতির শক্তির এই প্রকাশটিই ঘটেছে,

“একটা জিনিস আমার চোখে পড়ল। এতবড় শোভাযাত্রা কিন্তু শৃঙ্খলা ঠিকই রেখেছে। পাঁচ-সাত লক্ষ লোক মনে হল। পরের দিন কাগজে দেখলাম, পাঁচ লাখ। বিপ্লবী সরকার সমস্ত জাতটার মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে নতুন চিন্তাধারা দিয়ে।”

আত্মসন্মান আর মর্যাদার যে বোধটা জেগে উঠেছে, তা যেমন দরকষাকষি করে বাজারে দাম বেশি না নেয়ার মাঝে প্রকাশিত, তেমনি প্রকাশিত ব্যক্তিগত সততার প্রদর্শনেও। একজন বাঙালি কর্মকর্তার স্ত্রী বেগম মাহবুবের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন,

“…কলম পাওয়া গেল না। তখন ভাবলেন, রিকশায় পড়ে গিয়াছে, আর পাওয়া যাবে না। পরের দিন রিকশাওয়ালা নিজে এসে কলম ফেরত দিয়ে গিয়েছিল। এ রকম অনেক ঘটনাই আজকাল হচ্ছে। অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে চীনের জনসাধারণের মধ্যে।”

কৃষিতেও সূচিত হয়েছে আমূল বদল,

“এখন আর জনগণ বিশ্বাস করে না, পূজা দিয়ে ভাল ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। কমিউনিস্ট সরকার জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে চাষিদের মধ্যে বিলি বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। ফলে ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক হয়েছে। চেষ্টা করে ফসল উৎপাদন করছে, সরকার সাহায্য করছে। ফসল উৎপাদন করে এখন আর অকর্মন্য জমিদারদের ভাগ দিতে হয় না। কৃষকরা জীবনপণ করে পরিশ্রম করছে। এক কথায় তারা বলে, আজ চীন দেশ কৃষক মজুরদের দেশ, শোষক শ্রেণী শেষ হয়ে গেছে।”

ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমান চিত্ত চীনা মুসলমানদের খোঁজখবর না নিয়েও পারেননি, দুবার তার উল্লেখ আছে প্রায় একই রকম:

“মুসলমানরা ও ইমাম সাহেব জানালেন তারা সুখে আছেন। ধর্মে-কর্মে কোনো বাধা কমিউনিস্ট সরকার দেয় না। তবে ধর্ম প্রচার করা চলে না।”

তাদের দলনেতা পীর মানকী শরীফকে নিয়ে “এক বিপদই হলো, তিনি ধর্ম মন্দির, প্যাগোডা আর মসজিদ এই সব দেখতেই বেশি আগ্রহশীল। আমরা শিল্প কারখানা, কৃষকদের অবস্থা, সাংস্কৃতিক মিলনের জায়গা ও মিউজিয়াম দেখার জন্য ব্যস্ত।“ বিপদ এ কারণেই যে ‘পর্যটকের মন’ চীনের হাজার বছরের স্থাপত্য দেখার মায়া কি করে ত্যাগ করবে! কিন্তু পাকিস্তানের স্বাধীনতা নিয়ে অস্বস্তি আর না পাওয়ার অনুভূতি ইতিমধ্যেই যার মাঝে জেগে উঠেছে, তিনি সঙ্গতকারণেই চোখ ভরে দেখতে চাইবেন, কান পাততে চাইবেন চীনা-জনতার জীবনতন্ত্রীতে। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা আর ব্যক্তিগত স্বাজাত্য বোধের বিকাশ  ব্যষ্টিক আর সামষ্টিক উভয় ক্ষেত্রেই কতটা পরিবর্তন আনে, তার একটা তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিদেশী পণ্য নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতায়:

 “আর এগুলো কেউ কিনেও না। চীন দেশে যে জিনিস তৈরি হয় না, তা লোকে ব্যবহার করবে না। পুরানা আমলের ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কাটা হয়। আমার আর উপায় রইল না, শেষ পর্যন্ত হোটেলের সেলুনেই দাড়ি কাটাতে হলো। এরা শিল্প কারখানা বানানোর জন্যই শুধু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। আমাদের দেশে সেই সময়ে কোরিয়ার যুদ্ধের ফল স্বরূপ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছিল তার অধিকাংশ ব্যয় হল জাপানি পুতুল, আর শৌখিন দ্রব্য কিনতে। দৃষ্টিভঙ্গির কত তফাৎ আমাদের সরকার আর চীন সরকারের মধ্যে! এদেশে একটা বিদেশী সিগারেট পাওয়া যায় না। সিগারেট তারা তৈরি করছে নিকৃষ্ট ধরনের, তাই বড় ছোট সকলে খায়। আমরাও বাধ্য হলাম চীনা সিগারেট খেতে। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হয়েছিল কড়া বলে, আস্তে আস্তে রপ্ত হয়ে গিয়েছিল।”

মেহমানদের শুধু ভাল ভাল জিনিস দেখানো হতে পারে, খারাপগুলো ঢেকে রেখে, এই সংশয়ও তাঁর ছিল। তাই পূর্বপ্রস্তুতির সময় না দিয়ে দেখতে যান শ্রমিকদের গৃহস্থালী, এবং সেখানে মধ্যবিত্তের বাসের উপযোগী পরিবেশ দেখে তৃপ্ত হন। সাংহাইতে তখন

“নতুন নতুন স্কুল, কলেজ গড়ে উঠেছে চারিদিকে। ছোট্ট ছো্ট ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ভার সরকার নিয়েছে। চীনের নিজস্ব পদ্ধিতিতে লেখাপড়া শুরু করা হয়েছে।”

বিলাসিতা নিয়েও তার পর্যবেক্ষণ মূল্যবান,

“দুই দিন তিয়েন শাং থেকে আমরা নানকিং রওয়ানা করলাম। গাড়ির প্রাচুর্য বেশি নাই। সাইকেল, সাইকেল রিকশা আর দুই চারখানা বাস। মোটরগাড়ি খুব কম। কারণ নতুন সরকার গাড়ি কেনার দিকে নজর না দিয়ে জাতি গঠন করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছে।”

সব মিলে এই ভ্রমণে তাঁর উপলদ্ধি হলো

“চীন দেশের লোকের মধ্যে দেখলাম নতুন চেতনা। চোখে মুখে নতুন ভাব ও নতুন আশায় ভরা। তারা আজ গর্বিত যে তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক।“

 ৪.  কিন্তু ওই পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল প্রধানত বাঙালি মুসলমানের রায়ে— কেননা আর কোন প্রদেশে পাকিস্তানের দাবি সম্প্রদায়গতভাবে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাকিস্তানের পক্ষে দেননি—অলীক হলেও আশার সূচনা যে সেখানেও ছিল, সেটা ঐহিহাসিকেরা বিভিন্ন গ্রন্থে নথিবদ্ধ করেছেন। কৃষকেরা যেমন ভেবেছিলেন জমিদার-জোতদার-মহাজনের শোষণমুক্ত দেশ পাবেন, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করা মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশও কিন্তু ভেবেছিল ‘অসাম্প্রদায়িক’ পাকিস্তান হবে দুর্নীতিমুক্ত, বিদেশী শোষণ মুক্ত, যেখানে জীবনের বিকাশ ঘটবে সাবলীল গতিতে।  শেখ মুজিবুর রহমানও তার বিবরণ দিয়েছেন: কিছু অর্থ খরচ করে এমএলএদের ভোট কিনে প্রধানমন্ত্রী পদটা সুনিশ্চিত করার প্রস্তাবে

“শহীদ সাহেব মালেক সাহবকে বললেন, ‘মালেক পাকিস্তান হয়েছে, এর পাক ভূমিকে নাপাক করতে চাই না। টাকা আমি কাউকেও দেব না, এই অসাধু পন্থা অবলম্বন করে নেতা হতে আমি চাই না। আমার কাজ আমি করেছি। “

জনগণের মাঝেও মুক্তির স্পৃহাটা দেখেছিলেন তিনি,

“জনগণ ও সরকারি কর্মচারীরা রাতদিন পরিশ্রম করত। অনেক জায়গায় দেখেছি একজন কর্মচারি একটা অফিস চালাচ্ছে। একজন জমাদার ও একজন সিপাহী সমস্ত থানায় লীগ কর্মীদের সাহায্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করছে। জনসাধারণ রেলগাড়িতে যাবে টিকিট নাই, টাকা জমা দিয়ে গাড়িতে উঠছে। ম্যাজিকের মত দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে সকল কিছুতেই ভাটি লাগল, শুধু সরকারের নীতির জন্য। তারা জানত না, কি করে একটা জাগ্রত জাতিকে দেশের কাজে ব্যবহার করতে হয়।”

চীন ভ্রমণটি তার মাঝে মর্মযাতনার উপলদ্ধি এনেছিলো সঙ্গত কারণেই,

“আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন। ফলে দেশের জনগণের মধ্যে ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। একটা মাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল সাদা চামড়ার জায়গায় কালা চামড়ার আমদানি হয়েছে।”

শাসকের চামড়ার রঙে পার্থক্য থাকলেও পাকিস্তান ছিল বহু অর্থে উপনিবেশিক শাসনেরই ধারাবাহিকতা। অনেক বেশি আশাবাদের জন্ম দিয়েছিল বাংলাদেশের জন্ম, কেননা ভারত আর পাকিস্তানের মত উপনিবেশের হাত থেকে কেবল ক্ষমতার স্থানান্তর নয়— সমকালীন চেতনা রক্তস্নাত মূর্তিমান বিপ্লব হিসেবেই তাকে চিনে নিয়েছিল। আজকে আমাদেরও সামান্য পরে স্বাধীন হওয়া, আমাদের চেয়ে হানাদারের বোমায় বহুগুন পুড়ে অঙ্গার হওয়া ভিয়েতনামের শ্রমিকের তুলনায় অর্ধেকেরও কম মজুরিতে প্রায় পশুর খোয়ারের মত কারখানাগুলোতে শ্রম বিক্রি করেন স্বদেশে, বিমানের চাকায় পিষ্ট হয়ে কী গাদাগাদি ট্রাকে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে অথবা নৌকাডুবির শিকার হন অচিন সব সীমান্তে, ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির হিসেব বাদ দিলেও সামষ্টিক চেতনায় তার মর্মযাতনা অসহনীয়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর মুজিবুর রহমান খেয়াল করলেন পাকিস্তান আন্দোলনের যারা একনিষ্ঠ কর্মী, তারাই স্বাধীন পাকিস্তানে সবচে বেশি নিপীড়নের শিকার। অন্যদিকে যারা নিত্য শাসকদের তোয়াজ করে চলতো, সেই খাজাগজরাই রাষ্ট্রের নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের লুণ্ঠনকে পাকাপোক্ত করার প্রয়োজনে

“আমাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা লাগিয়ে দিত। অন্যদিকে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ড ভেঙে দিতে হুকুম দিলেন। জহিরুদ্দীন, মির্জা গোলাম হাফিজ এবং আরও কয়েকজন আপত্তি করল। কারণ, পাকিস্তানের  জন্য এবং পাকিস্তান হওয়ার পরে এই প্রতিষ্ঠান রীতিমত কাজ করে গিয়েছে। রেলগাড়িতে কর্মচারির অভাব, আইনশৃঙ্খলা ও সকল বিষয়েই এই প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে। হাজার হাজার ন্যাশনাল গার্ড ছিল। এদের দেশের কাজে না লাগিয়ে ভেঙে দেয়ার হুকুমে কর্মীদের মধ্যে একটটা ভীষণ বিদ্বেষ ভাব দেখা গেল। ন্যাশনাল গার্ডের নেতারা সম্মেলন করে ।ঠিক করলেন তারা প্রতিষ্ঠান চালাবেন। জহিরুদ্দীনকে সালারে-সুবা করা হল। জহিরুদ্দীন ঢাকায় আসার কিছুদিন পরেই তাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হল। মিস্টার মোহাজের, যিনি বাংলার ন্যাশনাল গার্ডের সালারে-সুবা ছিলেন তাকে নাজিমুদ্দীন সাহেব কি বললেন জানি না। তিনি খবরের কাগজে ঘোষণা করলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে, ন্যাশনাল গার্ডের আর দরকার নাই। এই রকম একটা সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান জাতীয় সরকার দেশের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার না করে দেশেরই ক্ষতি করলেন। এই সংগঠনের কর্মীরা যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছেন, অনেক নেতার চেয়েও বেশি। অনেকে আমাদের বললেন, এদের দিয়ে যে কাজ করাব, টাকা পাব কোথায়? এ্ররা টাকা চায় নাই। সামান্য খরচ পেয়েই বৎসরের পর বৎসসর কাজ করতে পারত… ন্যাশনাল গার্ডদের বেতনও দেয়া হত না। ন্যাশনাল গার্ড ও মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে যে প্রেরণা ছিল পাকিস্তানকে গড়বার জন্য তা ব্যবহার করতে নেতারা পারলেন না।”

ন্যাশনাল গার্ডদের সংগঠন ভেঙে দেয়ার প্রশ্নে তাঁর ভাষায় ‘নেতাদের লীলাখেলা বুঝতে কষ্ট হয়েছিল”, কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলনের এই স্বেচ্ছাসেবীদের তুলনায় রাজনৈতিকভাবে বহুগুন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে পোড় খাওয়া মুক্তিবাহিনীকেও তো ভেঙে দেয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পরপরই– জাতি গঠনের কাজে না লাগিয়ে, দেশের পুনর্গঠনে তাদের অকাতর শ্রমকে ব্যবহার করার  আদৌ উদ্যোগ না নিয়ে। সেক‌টর কমান্ডর কাজী নুরুজ্জামান তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে জানিয়েছেন এই মুক্তিযোদ্ধারা রাজি ছিল কয়েক বছর বিনা বেতনে দেশের কাজ করতে, কেননা তারা তো যুদ্ধে এসেছিল দেশের জন্য প্রাণ দিতেই, কয়েক বছর তাদের জন্য কি আর এমন। তারা বিদ্যালয়ে শিক্ষকের কাজ করতে চায়, তারা নিরক্ষরতা দূর করার অভিযানে নামতে চায়, তারা বিধ্বস্ত দেশের সড়ক-সেতু মেরামত করতে চায়, তারা কৃষিতে সহায়তা করতে চায়। তারা আইন-শৃঙ্খলা আর জননিরাপত্তার কাজ করতে চায়। শুরুতেই যেটা বলেছিলাম, কোন বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার এই স্পৃহার মূল্যমান নির্ধারণ করা যায় না। সেটা কিন্তু হলো না, বরং সাবেকি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটাই পুনর্বহাল রইলো। মুক্তিযোদ্ধাদের এভাবে পিছনে হটিয়ে দেয়ার পরিনতিতে সমাজে যে অরাজকতা সৃষ্টি হলো, পাকিস্তান-ভারতের মত কেবল ফাটকাবাজারি আর কারোবাজারিতেই তা সীমাবদ্ধ রইলো না। শুরু হলো ক্ষমতাবানদের সশস্ত্র লুণ্ঠন। মুক্তিযুদ্ধের তিন দিকপাল এ কে খন্দকার, মাঈদুল হাসান আর এস আর মীর্জার কথোপকথনের ওপর ভিত্তি করে রচিত মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর গ্রন্থটিতে এই অনিয়ন্ত্রিত লুণ্ঠন সমাজে যে অদৃষ্টপূর্ব ভাঙন, দলবাজি আর নৈরাজ্য নিয়ে এলো, তার একটা চিত্র আঁকা আছে।

৫.  সকল উদ্দীপনা তাই দ্রুতই মিইয়ে যেতে থাকে, প্রায় যেমনটি গিয়েছিল ৪৭ এর পরও। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধের পর মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ না হআর গ্লানিটা আরও বেশি তীব্র, কেননা আশা আর প্রতিজ্ঞা দুইই সেখানে আরও অনেক বেশি দৃঢ়তর ছিল। প্রতারিতের বেদনা শুরুতে হয়তো শূলের মতই বেঁধে, তারপর সহে যায়—কিংবা হয়তো আমাদের অগোচরে কাজ করে যায়…  ১৫ অগাস্টের পর মর্মযাতনায় দেশত্যাগের কথাও ভেবেছিলেন যিনি, স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর পর সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ সেই শামসুদ্দীন আবু জাফরের দিনপঞ্জীতে আমরা প্রায় নিত্যদিনের বর্ণনায় যে দৃশ্যকে দেখবো অসহনীয় মর্মযাতনা হিসেবে, আজকে যেন তা অনেকটাই প্রাত্যহিকী, ধীরে অভ্যাস হয়ে গেছে।

“[১৬ এপ্রিল ১৯৭৫] আজ ঘোড়াশালের মেলা। বাড়িতে কাটালাম। ছোটবেলায় মেলায় যাওয়ার যে উত্সাহ দেখতাম গ্রামবাসীর মধ্যে আজ তার সিকিও দেখলাম না। লোকজন বোরো ধান কাটায় ব্যস্ত। পেটের তাড়ায় অস্থির। মেলার কথা স্মরণও নেই। দেশের বাড়িতে কাটালাম। দেশের দরিদ্র ক্ষেতমজুরেরা বলল, তারা আটার ‘লোডানি’ মানে আটা গরম পানিতে সেদ্ধ করে বার্লির ন্যায় খেয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে। অনেকের হাত-পা মুখে পানির ভার। এবার কাঁঠালও খুব কম। নতুন বোরো ধান ১২৫ টাকা দর শুনলাম, তবে ভালো শুকনো নয়।“

এবং এর ক’দিন পরের আরেকটি ভুক্তি:

[১১ আগস্ট ১৯৭৫] “সকালে প্রাতঃভ্রমণের সময় সৈয়দ মান্নান বখশের বাড়িতে যাওয়ার পথে নিউ বেইলী রোডের কিনারে ম্যানহোলের ঢাকনার ওপরে দেখলাম একটি ৫-৭ বছরের ছেলে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। উদাম গা, পরনে পুরোনো ময়লা হাফপ্যান্ট। স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালো। আশপাশে কাউকে দেখলাম না। বোধ করি পিতৃমাতৃহীন অথবা পিতামাতা কর্তৃক পরিত্যক্ত—কুড়িয়ে খায়। এবং যেখনে রাত হয়, ঘুমায়। সম্পন্ন ঘরে জন্মালে এ ছেলেই উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জর্জ, ম্যাজিস্ট্রেট, রাজনীতিক ,মন্ত্রী, এম.পি এমন কি রাষ্ট্রের সর্বেসবা আর একটি শেখ মুজিব হতে পারত। মুজিবরা মার্সেডিসে চড়েন আর এ ছেলে ম্যানহোলে ঘুমায়। এই হলো ১৯৭৫-এর বাংলাদেশ। যে দেশের বাজেটের শতকরা ৭৪ ভাগ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, সে-দেশের প্রেসিডেন্ট একটি নয়, দুটি মার্সেডিস আনছেন। ৩০,০০০ পাউন্ড প্রতিটির দাম। সরকারি রেটে ৯,০০,০০০ টাকা লন্ডনের দাম। ট্যাক্স সমেত এখানে পড়বে ২৭,০০,০০০ টাকা দাম। আজও বেতন পাওয়া গেল না। টেলিফোন খারাপ আছে। “ 

৬. এই প্রক্রিয়াতেই মুক্তিযুদ্ধে যারা হানাদার বাহিনীর সাথী হয়ে নিজের দেশের জনগণের চেতনাকে দমন করার চেষ্টা করেছিল খুন-ধর্ষণ-লুণ্ঠন আর অগ্নিসংযোগের খাণ্ডব দাহনে, রাজাকার আর আল বদরের মত এমন সংগঠন তৈরি করেছিল, যাদের কাজ হবে নিজ জাতির অগ্রগণ্য মানুষ আর মুক্তিকামী কর্মীদের হত্যা করা, তাদের বড় অংশই ধীরে ধীরে ক্রমশঃ বন্দীদশা থেকে ছাড়া পেতে থাকে। এইভাবে ছাড়া পায় শাহ্ আজিজুর রহমান, ছাড়া পায় মুক্তিযুদ্ধকালীন মালেক মন্ত্রীসভার সদস্যরা। স্থানীয় পর্যায়ে যাদের সাথে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের শত্রুতা ছিল, সে সব গণশত্রুরা আটক থাকলেও যারা আপোষরফা করে ফেলতে পেরেছিলেন, তারা ঠিকই ছাড়া পায়। শুরুতে এমন প্রক্রিয়ায় এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয় যেন যুদ্ধাপরাধ সাধারণ ফৌজদারি মামলা। ফলে তার রাজনৈতিক তাৎপর্য হারিয়ে যায়, হয়ে পড়ে সাক্ষী-সাবুদের বিষয়। প্রয়োজন ছিল স্বাধীনতার পরপরই এইভাবে গণহত্যা চালানো গণশত্রুদের প্রধান সংগঠক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। সেটা করা হয়নি, গোলাম আজমরা দেশে ফিরতে না পারলেও ঠিকই তার ‘দ্বিতীয় ব্যক্তি’ মাওলানা আবদুর রহীম কিংবা আব্বাস আলী খানেরা কাজ গুছিয়ে এনেছেন। এভাবে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ঘাতকরা রাজনীতি-সংস্কৃতি-অর্থনীতিতে, নারীর অগ্রগতির বিরোধিতায় তাদের থাবা বিস্তার করেছে জিয়াউর রহমানের আমলে আরও প্রকাশ্যে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শাহ্ আজিজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে। ফলে ঠিক স্বাধীনতার সূচানবিন্দুতে যে লক্ষণগুলো পরিস্কার হয়, যে ফৌজকে ছত্রখান করে ফেলা হয়, আর রক্ষীবাহিনীর মত যে সংগঠনগুলোকে গড়ে তোলা হয়, পরবর্তীকালের বাংলাদেশ ঠিক সেই ধারাবাহিকতার পথেই এগিয়েছে। বাংলাদেশের পরবর্তীকালের প্রতিটি দুর্ভাগ্যের ইঙ্গিত তার জন্মপরবর্তী কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহে পাওয়া যাবে, প্রতিটির বীজ অঙ্কুরোদগমিত হয়েছে প্রথম কয়েক বছরের শাসনে। পরবর্তীতে সেই গাছগুলোই ডালপালা মেলে লুণ্ঠন, ফাটকাবাজারি আর অপরাধবৃত্তির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে বাংলাদেশকে। এমনকটি আস্ত দেশটিও আজ বহুজাতিক পুঁজি আর সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের কাছে বিক্রির পণ্য। শাসকরা হতাশ করতে পারে, তাদের উত্তোরোত্তর আর ধারাবাহিক দুর্নীতি আর ক্ষমতার পুঞ্জীভবন স্বৈরশাসনকে উত্তরোত্তর পাকাপোক্ত করে মুক্তিসংগ্রামী একটা প্রজন্মকে হতাশ আর ভাঙা-হৃদয়ের করে তুলতে পারে, কিন্তু তারপরও আয়ারল্যান্ডের যে পর্যুদস্ত চাষীর বর্ণনা ওপরে আমরা পেয়েছি, আপাত সাদৃশ্য সত্ত্বেও ওই দুই এক নয়। পর্যূদস্ত মন যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করেনি, তার প্রমাণও আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে।

এটা সত্যি, প্রজ্ঞা আর জনহিতাকাঙ্ক্ষা চালিকাশক্তি হলে উৎপাদন আর জনশক্তি সকল দিক দিয়েই যে বিকাশ আমাদের হতে পারতো, তার সিকি ভাগও হয়নি। হয়নি, তার প্রমাণ ওই উপনিবেশিত আযারল্যান্ডের মতই, কীর্তিমান বাঙালি দুনিয়া জুড়ে অজস্র আছেন, কিন্তু তার মাতৃভূমিটিই মানবিক বিকাশের পথে বড় অন্তরায় বলে সেখানেই তারা সংখ্যায় সবচে কম। জনগণের জন্য সার্বজনীন মানসম্পন্ন শিক্ষার বন্দোবস্ত রাষ্ট্র করেনি বটে, সংখ্যা আর অক্ষর পড়তে সক্ষম সস্তা পোষাক শ্রমিক বানাবার জন্য রাষ্ট্র নারীর জন্য বিনামূল্যের অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানহীন শিক্ষারও ব্যবস্থা করেছে বটে, কিন্তু এই যে বিপুল কর্মস্রোত আমরা চতুর্দিকে দেখি, এটাই আমাদের নতুন আশা। নিজেদের তুচ্ছ স্বার্থে ধর্মের অকাতর ব্যবহারে এই শাসকেরা যতই পটু হোক, একরোখা যে শ্রমিকশ্রেণিকে সে ধীরে ধীরে নির্মাণ করছে রফতানিমুখী শিল্পাঞ্চলগুলোতে—তারাই একদা য়ুরোপের ধর্মনিরপেক্ষতা আর গণতন্ত্রের ভিত নির্মাণ করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান চামড়ার রঙের পার্থক্য সত্ত্বেও শোষণের, সম্পদ পাচারের ধারাবাহিকতা যে অব্যাহত ছিল সেটা খেয়াল করেছিলেন সঠিকভাবেই। সেই ধারাবাহিকতাই তো অক্ষুণ্ন রইলো বাঙলাভাষীদের শাসনেই সুন্দরবনের মত জাতীয় গৌরবকে পরের স্বার্থে জলাঞ্জলি দেয়ার সিদ্ধান্তে। কিংবা একের পর এক খনিজ সম্পদের ক্ষেত্র বহুজাতিকদের কাছে ইজার দিয়ে গুটিকতকের পকেট ভারী করার বন্দোবস্তে। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাঠ তাই এই শিক্ষাটুকুই দেয়, অনেকটা অগ্রগতি সত্ত্বে যুদ্ধটাও অসমাপ্তই রয়ে গেছে, মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদের প্রত্যাশিত রাষ্ট্রটি এই ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেই লড়াই চলছে, চলবে।  

ফিরোজ আহমেদ
সদস্য,রাজনৈতিক পরিষদ
গণসংহতি আন্দোলন

[বর্তমান নিবন্ধটি গত ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৩ দৈনিক কালেরকণ্ঠের সাহিত্য সাময়িকী শিলালিপিতে স্থানাভাবে অতিসংক্ষেপিত আকারে প্রকাশিত হয়েছিল।]***বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠের অভিজ্ঞতাজাত অনুভূতি থেকে লেখা এই রচনাটি। সুন্দরবনে সম্প্রতি (৯ ডিসেম্বর, ২০১৪) যে মহাবিপর্যয় ঘটলো, আন্তর্জাতিক প্রভূদের খুশী করতে যে বিপর্যয়ের ছক আঁটা হচ্ছে রামপালে, ফুলবাড়িতে কিংবা রূপপুরে, তার প্রেক্ষাপটে দাঁড় করালে স্বাধীন আর নতজানু শাসকদের এই পার্থক্যটাই মনে পড়ে নতুন করে: যারা দেশটাকে চালাচ্ছে, এটাকে তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের বাসস্থান বলে ভাবলে কেবল দুটো কমিশনের বিনিময়ে এমন কাজ তারা করতে পারতো না। আত্মনিয়ন্ত্রণে সক্ষম কোন  জাতি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কোন দুর্যোগে পড়লে ভবিষ্যতে সেটা মোকাবেলার বন্দোবস্ত করে। পরগাছা শাসককেরা জনগণের দুর্ভোগকে ব্যবহার করে কেবল প্রভূদের জন্য নতুনতর কোন বাণিজ্যের ফন্দি আঁটতে।[বর্তমান নিবন্ধটি গত ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৩ দৈনিক কালেরকণ্ঠের সাহিত্য সাময়িকী শিলালিপিতে স্থানাভাবে অতিসংক্ষেপিত আকারে প্রকাশিত হয়েছিল।

Leave a Reply