You are currently viewing ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের চাপের মুখে বাংলাদেশ; জাতীয় স্বার্থের কি হবে?

ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের চাপের মুখে বাংলাদেশ; জাতীয় স্বার্থের কি হবে?

৫০ বছর আগে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই মার্কিন নেতৃত্বে এদেশকে বাস্কেট কেস এবং উন্নয়নের পরীক্ষাগার হিসেবেই চিত্রিত করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরের কয়েক দশক বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত ছিল মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং দুর্নীতির মতো নেতিবাচক সংবাদের মাধ্যমে। কিন্তু পাঁচ দশক পরে চীনের মহা উত্থান, ভারত ও চীনের নানামুখী দ্বন্দ্ব ও এশিয়ার বিরাট বাজার এখন বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব ভীষণভাবে বাড়িয়ে তুলেছে।

সম্প্রতি (১৭-২১ নভেম্বর,২০২১) বাংলাদেশ সফরে আসা রাষ্ট্রদূত কেলি কেইডারলিং বলেন, অর্থনীতি ও নিরাপত্তার ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশ সম্পর্কে পুরনো ধারণা থেকে সরে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সঙ্গে তারা আগামী ৫০ বছরে এই ২ দেশের মধ্যকার সম্পর্ক নতুনভাবে চিত্রায়ন করতে চাইছে বলে মন্তব্য করেছেন এক শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তা। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ একটি পোশাক প্রস্ততকারক এবং দরিদ্র স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে, এগিয়ে চলা অর্থনীতি এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে বিশ্ব নিরাপত্তায় অন্যতম অবদান রাখায় বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা বদলেছে।

বিশেষ গুরুত্ব বিবেচনায় এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বাকী ৫টি দেশকে ভারত থেকে আলাদাভাবে তদারকি করার আমলাতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। কেলি কেইডারলিং মন্তব্য করেছেন, ’আমরা বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার বাকী দেশগুলোর সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের তত্ত্বাবধানে আপনাদের (বাংলাদেশের) অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা চাই। কারণ আমরা চাই না, ভারতের সঙ্গে থাকা গভীর সম্পর্কের কারণে এই ৫টি দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ুক।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির ট্রেডমার্ক ডিসকোর্স গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সমতা ও শ্রম অধিকার নিয়েও এবারো তারা এসেছেন। এসব বিষয়ে কেইডারলিং বলেন, ‘আমেরিকানরা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছে, যা মৌলিক মূল্যবোধ। মূল কথা হলো, আমরা শুধু ব্যবসা করতে এবং অর্থ উপার্জন করতে চাই না। আমেরিকান কূটনীতি গণতন্ত্র রক্ষা ও অগ্রসর করতে চায়।’

অন্যদিকে প্রায় দেড় দশক ধরে ভারত আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। ভারতের কূটনীতিক এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে দ্বিধাহীন সমর্থন পেয়েছিল, তার মাধ্যমেই এ বিষয়ে ভারতের অবস্থান পরিষ্কার। ভারত আওয়ামী লীগকে প্রশ্নহীনভাবে সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় সেই বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই আছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও এখন অবকাঠামোসহ প্রায় সকল খাতে চীনের অবস্থান আগের চেয়ে অনেক বেশি জোরালো হয়ে উঠেছে। ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকদের মতে, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এখন চীনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলের ভূরাজনীতির গোটা কাঠামোকেই পুরোমাত্রায় পাল্টে দিয়েছে বেইজিং। কিছুদিন আগেও এ অঞ্চলে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ ধরা হতো ভারতকে। সে জায়গা এখন চীনের দখলে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট বেঁধে আঞ্চলিক ভূরাজনীতির ভরবিন্দুর এ আমূল পরিবর্তন মোকাবেলায় বেশ জোর প্রয়াস চালিয়েছে নয়াদিল্লি। সক্রিয় করে তোলা হয়েছে প্রায় বিস্মৃত কোয়াড জোটকে। যদিও সে প্রয়াসও খুব একটা কাজে দেয়নি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশই এ জোটে যোগ দেয়নি।

টিকাকে হাতিয়ার করে কভিডকালীন ভূরাজনীতিতে চীনকে টেক্কা দেয়ার জোর প্রয়াস চালিয়েছিল ভারত। চলতি বছরের শুরুর দিকেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ভ্যাকসিনের জন্য নয়াদিল্লির ওপরেই নির্ভর করেছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু মহামারী প্রকট আকার নিলে টিকা আরোপে বাধ্য হয় নয়াদিল্লি।  রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা তাদের টিকা কূটনীতিতে বুমেরাং বলে পরিচিত হয়েছে। গোটা দক্ষিণ এশিয়াতে কভিডের নতুন সংক্রমণে বিপাকে পড়ে যাওয়া দেশগুলোর পাশে  এগিয়ে এসেছিলো চীন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের ভূমিকা অনেকটা নীরব পর্যবেক্ষকের। বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হলে ভারতীয় আন্তর্জাতিক চাণক্যদের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। এই অঞ্চলের কূটনৈতিক সম্পর্কগুলোর মৌলিক বিষয়বস্তুতে এখন আমূল পরিবর্তন এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও এখন নিজ নিজ চিরাচরিত ভূমিকা থেকে বেরিয়ে আসছে। এ পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাবক চীন। নানা খাতে এখানকার দেশগুলোর সঙ্গে বেইজিংয়ের অংশীদারিত্বের সম্পর্ক দিন দিন দৃঢ় হচ্ছে।

কৌশলী খেলোয়াড় হিসেবে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রতি চীন-ভারত দুই দেশেরই স্বার্থসংশ্লিষ্টতাকে কাজে লাগাতে চান। তিনি এই দুই আঞ্চলিক খেলোয়াড়ের সাথে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বে কমই জড়াতে চান। সবসময় যে সুবিধা করা যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে শেখ হাসিনার সামনে যে পরিবেশ তাতে দুই বড় দেশকেই তার প্রয়োজন। এর মধ্যে মাত্রাগত পার্থক্য হলো কভিড উত্তর অর্থনৈতিক উত্তরণের সময়ে শ্লথগতি ও তহবিল সঙ্কটের মোকাবেলায় চীনের সহায়তার প্রয়োজন হবে অনেক বেশি।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ভারত  ও চীন কেউই প্রকৃত  বন্ধু নয়  কারণ  রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এরা কেউ মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করেনি  এবং অদূর ভাবিষ্যতে করবে এমন লক্ষণও রেখা দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের সাথে ভারতের নদীর পানি বন্টন চুক্তি, তিস্তা চুক্তি  বাস্তবায়িত হয়নি এবং সীমান্তে  হত্যা শূন্যের  কোঠায়  নামিয়ে  আনবে বলে ভারত যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাও বাস্তবায়িত হয়নি বরং আরও  বেড়েছে। আবার  বাংলাদেশ বাণিজ্যিক  চুক্তি মান্য  করলেও ভারত অনেক ক্ষেত্রে অমান্য করেছে, তার সর্বশেষ নজির হলো পেঁয়াজকান্ড ও কভিডের ভ্যাকসিন নিয়ে ভারতের নির্লজ্জ স্বার্থপরতা।

সরকারকে বাংলাদেশের  জাতীয়  স্বার্থকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার  দিয়ে কাজ করতে হবে। অনির্বাচিত ও জনসম্মতিহীন এই সরকার যে দরকষাকষিতে নাজুক অবস্থায় আছে সেটাতো বলাই বাহুল্য। জনসম্মতির বলে বলীয়ান কোন দেশপ্রেমিক সরকার এই পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে নিজ দেশের স্বার্থে দরকষাকষি করে সর্বাধিক সুবিধা আদায় করতে পারতো। অন্যদিকে জনসম্মতিহীন ও ভীষণভাবে অজনপ্রিয় সরকার দেশের বদলে নিজেদের গোষ্ঠীগত স্বার্থকেই সর্বাগ্রে রাখবে, বাংলাদেশের সরকারের ক্ষেত্রে এই কথাটিই প্রযোজ্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎপার্থীদের তালিকাতেও সেই লক্ষণই বিদ্যমান।

ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে নিজ দেশের স্বার্থে দরকষাকষি করে সর্বাধিক সুবিধা ও সুযোগ সৃষ্ঠি করতে পারে সুনির্বাচিত সংসদ। বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকার ও প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের পক্ষে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা যায় না। তাতে মসনদ ঠিক রাখা যায় না। ২০২১ সালে, শেখ হাসিনা বলেন, ‘বৃহৎ দুটি দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারিনি বলেই ২০০১ সালে আমাকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। আমি বলেছিলাম দেশের ৫০ বছরের চাহিদা পূরণ করে তারপর বিক্রি করব। তাছাড়া এ দেশের সম্পদ আমি বেচতে পারি না। এ কথা আমেরিকা আর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পছন্দ না হওয়ায় আমাকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি।

শেখ হাসিনার বক্তব্য থেকে সহজেই অনুমেয় ক্ষমতায় আসার জন্য আমাদের  ‘বড় দলগুলো উক্ত জণগন নয় বরং অনান্য দেশগুলোর ওপর নির্ভর করে। তাদের এই দূতাবাস নির্ভর রাজনীতি বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে আরো বেশি বসবাস অনুপোযোগী করে তুলছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরনের জন্য চাই জণগণের রাজনৈতিক দল। সময় উপযোগী রাজনৈতিক দলে সচেতন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নাগরিকদের সন্মিলন।

তথ্যসূত্র: ১. ‘গ্যাস বেচতে রাজি না হওয়ায় ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারিনি’

আব্দুল আলিম , জাতীয় পরিষদ সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন

#১১/৪/উৎসব মোসাদ্দেক

Leave a Reply