You are currently viewing ভিক্টিম ব্লেইমিং বন্ধ কর: পরীমনির অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীর বিচার চাই

ভিক্টিম ব্লেইমিং বন্ধ কর: পরীমনির অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীর বিচার চাই

 সংবাদ মাধ্যমে দেখলাম বাংলা চলচিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী পরীমনি একজন ব্যবসায়ীর নামে শারীরিক নির্যাতন এবং ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগ করেছেন। তিনি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন,  ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি বিচারের জন্য চারদিন ধরে বিভিন্ন থানা ও ক্ষমতাধর ব্যাক্তিদের কাছে ছোটাছুটি করেও কোন বিচার পাননি। পুলিশের কাছে মামলা করতে গেলেও পুলিশ দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেয়। চারদিনেও তারা মামলা গ্রহণ করেনি। কারো কাছে কোন রকম সহযোগিতা না পেয়ে তিনি হতাশ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কে? তিনি কি এমন ক্ষমতার অধিকারী যে তার বিরুদ্ধে কেউ পরীমনিকে সহযোগিতা করতে আসেনি। কেনই বা পুলিশ মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করলো। আর কেনইবা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাইতে হবে এবং হস্তক্ষেপ কামনা করতে হবে। সবই যদি প্রধানমন্ত্রীকে করতে হয় তাহলে আইনবিভাগ, বিচারবিভাগের কাজ কি? এসকল দায়িত্বরত ব্যক্তিদেরকে জনগন কেন তাদের শ্রমের টাকায় পুষবে। কেন রাষ্ট্রের সকল কিছু এক ব্যক্তিকেন্দ্রীক আবর্তিত হয়ে আছে?  ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না কেন?

পরিমনি

পরীমনির ঘটনা কেন্দ্রীক এসব প্রশ্ন নিয়ে আমাদের মধ্যে যখন চিন্তার উদ্রেগ হওয়ার কথা ঠিক তখন আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি ভিক্টিম ব্লেইমিং নিয়ে। দু’দিন ধরে সোস্যাল মিডিয়াতে দেখছি পরীমনিকে নিয়ে ট্রল হচ্ছে। তার পেশা, পোশাক নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। একজন ফেসবুকে লিখেছেন “নর্তকীর আবার ধর্ষণের অভিযোগ, ব্যাপার টা হাস্যকর।” আরেকজন লিখেছে “সে যে পোশাক পড়ে তাতেতো ধর্ষণ হবেই। ” কি নির্মম কথা! এমন ধারণা পোষণকারী মানুষের কাছে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই কেউ সিনেমায় অভিনয় করলে, কেউ পতিতাবৃত্তি করলে, কেউ নাইট ক্লাবে গেলে কিংবা কারো পোশাকের কারণে কি তাকে ধর্ষণ করা বৈধ? সমাজ, রাষ্ট্র বা ধর্ম কি এমন বৈধতা প্রদান করেছে?

কারো পেশা, পোশাক, চলাফেরা কখনই ধর্ষণের কারণ হতে পারেনা। বরং এটা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। ধর্ষকদের চিন্তার সমস্যা। আমাদের রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থার সমস্যা। একজন নাগরিক হিসেবে তার যেকোন পেশায় যাওয়ার অধিকার রয়েছে। সে কি পোশাক পড়বে এটাও তার ব্যক্তিগত ব্যপার। কিন্তু তার অস্মতিতে তার শরীর স্পর্শ করাও গুরুতর অপরাধ। ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব কিভাবে গড়ে উঠছে? এর সাথে ক্ষমতা কাঠামোর সস্পর্ক কতোটুকু? এসব বিষয়ে চিন্তা না করে আমরা কোন ঘটনা কেন্দ্রীক ভিক্টিম ব্লেইমিং করে অপরাধীর অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করি। ধর্ষণের মতো হীন কাজকে জায়েজ করে ধর্ষকের পক্ষে সাফাই গাই। যার ফলে ভিক্টিমকে শারীরিক নির্যাতনের পর মানসিকভাবেও নির্যাতন করে তাকে ট্রমার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। উপায়ান্তর না পেয়ে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

 অন্যদিকে  আমরা ধর্ষককে মুক্ত করে ধর্ষণের মতো অপরাধকে উস্কে দেই। ফলত সমাজে ধর্ষকামী মনস্তত্ত্ব দ্রুত বিকশিত হয়। ধর্ষক মেতে উঠে ধর্ষণের সুখ আচ্ছাদনে। পরীমনির ঘটনা নিয়ে মানুষের যে কমেন্ট, হাহা রিয়্যাক্ট তাতে আমি আশ্চর্য হইনি। এটা আমাদের সমাজের প্রচলন হয়ে গেছে। এর আগেও এসব মানুষদের এমন নোংরা কথাবার্তা বলতে শুনেছি। ছাত্ররাজনীতি করার ফলে ন্যায়-অন্যায় বোধের বিষয়গুলো বুঝতে শিখেছি। সাংগঠনিক প্রাকটিসের কারণে যেকোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, সকলে মিলে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। ভিক্টিম ব্লেইমিং এর বিষয়টি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক আন্দোলন করতে গিয়ে দেখেছি। আমার মনে আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী তার বন্ধুর বাসায় গিয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হয় তখন আমরা শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করি। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখেছি আমাদের অনেক শিক্ষক ধর্ষকের পক্ষেই অবস্থান নেয়। তারা বলতে শুরু করে একজন মেয়ে কেন তার বন্ধুর বাসায় যাবে? আচ্ছা একজন মেয়ে তার বন্ধুকে বিশ্বাস করে তার বাড়ি গেলেই কি তাকে ধর্ষণ করা যাবে? এটা কি কোনভাবে বৈধ?

 রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী সন্ধ্যায় টিউশনি করে হলে ফেরার পথে দুজন মটোর সাইকেল আরোহী তার বুকের ওড়না কেড়ে নেয়। আমরা বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষ থেকে এর বিচার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার প্রশ্নে সেসময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রক্টরের সাথে দেখা করলেও এর বিচার পাইনি বরং বিভিন্ন মহল থেকে বলতে শুনেছি ওই মেয়ে সন্ধ্যায় বাইরে থাকে ফলে সে ভালো না। অর্থাৎ মেয়েটি টিউশনি করে তার নিজের খরচ বহন করবে এটাই তার জন্য কাল হয়ে গেলো।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের মেয়ে ছোট বেলায় টিএসসির গানের শিক্ষক কর্তৃক যৌন নিপীড়নের শিকার হয় কিন্তু সমাজের চাপে তখন কিছু বলতে না পারলেও কয়েক বছর পর সাহস সঞ্চার করে গানের শিক্ষকের নামে অভিযোগ তুলে বিচার চাইলে আমরা ছাত্র ফেডারেশন থেকে তাকে সংহতি জানিয়ে গতবছর মানববন্ধন করে সুষ্ঠ তদন্ত ও বিচার দাবি করি। সেখানেও আমরা ওই নিপীড়ক শিক্ষকের পক্ষেই অনেকের অবস্থান দেখে বিস্মিত হই৷ অনেকেই বলেছে মেয়েটি ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য এমন অভিযোগ করছে। যদিও সেদিন তাদের এমন ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে এর প্রতিবাদ করেছি।

শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই না সারা দেশেই ভিক্টিমকেই দোষারোপ করার ভয়ানক সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। আমরা অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি নিয়ে আলোচনা না করে আক্রান্ত নারীর চরিত্র হননেই ব্যস্ত থাকি। যার ফলে ধর্ষকরা পার পেয়ে যায়। বুক ফুলে ঘুরে বেড়ায়, তৈরী হয় সংকট। ভিক্টিম ব্লেইমিং এ ব্যতিব্যস্ত ব্যক্তিরা আসলে কি চায়। তারা কেন সর্বদা ধর্ষকের পক্ষাবলম্বন করে সেটাও গভীর চিন্তার বিষয়। আজকে পরীমনির অভিযোগের প্রেক্ষিতে  যারা তাকে নিয়ে কটুক্তি করছে তারা আমাদের সমাজে এক একটা ভাইরাস। এরা বিবেকবিচ্যূত, নৈতিক ও মানবিকভাবে পথভ্রষ্ট। আমাদের দেশে জ্যামিতিকভাবে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেমন দায়ী ঠিক তেমনি এসমস্ত ভাইরাস যুক্ত বাটপাররাও সমানভাবে দায়ী। তারাও ধর্ষকামী মনস্তত্ব গড়ে তোলার পিছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ফলে সমাজ থেকে ধর্ষণকে নির্মূল করার জন্য ধর্ষককে দ্রুত বিচারের আওতায় আনার পাশাপাশি ধর্ষকের পক্ষে সাফাই গাওয়া এ সমস্ত মানসিক সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কাউন্সেলিং করতে হবে।

এই কঠিন সময়ে পরীমনির সাহস সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয়। সমাজের অন্যান্য নারীরা যখন লোকচক্ষুর ভয়ে ও সামাজিক চাপে চুপ থেকে যায় ঠিক এমন সময়ে পরীমনির সাহস আমাদের আশা জাগায়। পরীমনির প্রতি শারীরিক নিপীড়ন এবং তাকে ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টার বিরুদ্ধে তিনি যে আওয়াজ তুলেছেন আমাদের উচিত হবে তাকে সংহতি জানিয়ে তার লড়াইয়ের ভাষাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া। পরীমনির অভিযোগের সুষ্ঠ তদন্ত করে অপরাধীকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। পুলিশ কেন চারদিনেও মামলা নেয়নি তার জবাবদিহি পুলিশকে করতে হবে। আজকে যদি পরীমনি বিচার না পায় তাহলে নির্যাতিত নারীর আওয়াজ বন্ধ হয়ে যাবে। নির্বাক হয়ে যাবে প্রতিবাদের ভাষা।

মহব্বত হোসেন মিলন
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা


#জ/উম-৬/৭

Leave a Reply