You are currently viewing ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চাই মানবিক সমাজ
Munir Chowdhuri Sohel Ganosamhati Andolon

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চাই মানবিক সমাজ

প্রচলিত সমাজ যান্ত্রিক, অমানবিক, অগণতান্ত্রিক। বছরের পর বছর আমরা এ সমাজের আইন – কানুন, ধর্মের বিধি – বিধান, অনুশাসন ও নিয়ম মেনে নিয়ে বসবাস করে আসছি। নিজেদের ভালো থাকার জন্য, নিজেদের সকল সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য, নিজেদের নিরাপত্তার হুমকি আসতে পারে এই আশঙ্কায় সমাজের অসংখ্য নিয়ম বা শিকলের বিরুদ্ধে কোন ধরণের প্রতিবাদ করি না। সমাজ অসুস্থ হয়ে গেছে। ক্রমান্বয়ে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সমাজের কাছ থেকে ন্যুনতম সুবিধাপ্রাপ্ত হবে বলে আমার কাছে মনে হয় না। সমাজ প্রগতির দিকে না যেয়ে বরং বিপরীত পথে হাঁটছে। গভীর অন্ধকার গ্রাস করছে। এ সমাজ নিরাপদ নয় বলে আমি মনুষ্য বসবাসের উপযোগী বলে মনে করি না।

অথচ এই অনিরাপদ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত প্রাকৃতজনেরা  অধিক হারে কর প্রদান করে থাকে। এক্ষেত্রে এখানে প্রাসঙ্গিক একটি যুক্তি হাজির করা যায়। বিশ্বের কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলোতে ধণীদের নিকট থেকে কর আদায় করা হয়। এই কর জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা যায়। যারা নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের নিকট থেকে বিভিন্ন করের ফাঁদ আবিষ্কার করে কর আদায় করা হয়। কিন্তু যারা বিত্তবৈভবে টইটুম্বর ও ঐশ্বর্যে নিমগ্ন থাকেন, যারা অর্থের পাহাড় গড়েন তারা কম কর দেন। তার উল্লেখযোগ্য কারণ – সম্পদশালীদের অবৈধ বা কালো টাকার আইনগত হিসাব থাকে না।

সাধারণ বিচারে পরিবারের সাথে যেমন সমাজের সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি সমাজের সাথে রাষ্ট্রেরও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যপুস্তকে এ ধরণের সম্পর্কের কথা উল্লেখ আছে। সমাজে বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরীহ সাধারণ জনগণ সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোন সুযোগ-সুবিধা কী পান ? আমরা একবাক্যে স্বীকার করবো – পাই না। 

আমি আমার লেখার সূচনালগ্নে উল্লেখ করেছি – বর্তমান সমাজ যান্ত্রিক। আমি নিশ্চিত, এ সমাজে যারা সুবিধাবঞ্চিত তারা কেউই এ মন্তব্যের বিরোধিতা করবেন না। সমাজটি যান্ত্রিক বিধায় সমাজ মানবিকও নয়। ফলে সমাজের অভ্যন্তরে বসবাস করার পরও  মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ে উঠছে না। নিরীহ সাধারণ মানুষ চরম নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। নিরাপত্তা এখন রাষ্ট্রীয় খাঁচায় বন্দী। ঘরে-বাইরে এমন কী কর্মস্থলে মানুষের সামান্যতম নিরাপত্তা নেই। নিরাপত্তাহীনতার কারণে নির্ভয়ে ও নিরাপদে বাসা থেকে বেরিয়ে সাধারণ কাজ-কর্ম শেষ করে বাসায় প্রবেশ করতে পারবেন কিনা সেক্ষেত্রে মানুষ সন্দিহান । ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারীরা আক্রান্ত হয় বেশি। প্রধানত তাদের ভোগের সামগ্রী হিসেবেই দেখা হয়। কর্মস্থলে  পুরুষ সহকর্মীদের” দ্বারা আক্রান্ত হয়। পুরুষ সহকর্মীদের সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও পরামর্শের বিপরীতে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হন। সম্মান ও মর্যাদাহানির আশঙ্কায় পুরুষ সহকর্মীদের বিরুদ্ধে কোনরূপ অভিযোগ করার চিন্তা করতে পারে না। অমর্যাদার গ্লানী নীরবে সহ্য করে জীবন চলার পথে হাঁটতে হয়। মানুষ হিসেবে নারীরা তাদের মর্যাদা পায় না।

অর্থনৈতিক অবস্থা ভঙ্গুর হবার কারণে মধ্যবিত্তরা এখন আর মধ্যবিত্ত নেই। মধ্যবিত্ত সীমার বাইরে চলে গেছে। নিম্ন-মধ্যবিত্তে পরিণত হয়েছে। জীবিকার বেলায় দেখি, ঘরে – ঘরে চাকরী নেই। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া জানা শিক্ষিত ও অশিক্ষিত কোটি-কোটি মানুষ বেকার। ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে স্বপ্ন বুনেছিল তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তাদের জীবন ও জীবিকা গভীর সংকটে নিমজ্জিত। 

এই সব কর্মহীন মানুষের সিংহভাগই সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত। সন্ত্রাস এখন তাদের কর্মসংস্থানে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাসের মাত্রা বৃদ্ধি পাবার সাথে-সাথে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। খুন-ধর্ষণ-সন্ত্রাস-রাহাজানি ক্ষিপ্রগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরাধের মাত্রা এতো বৃদ্ধি পেয়েছে যে, সমাজে অস্ত্রধারী, অপরাধীরা ভয়ংকর রূপে প্রকাশিত। ভয়ানক অপরাধের পাশাপাশি আরেকটি অপরাধমূলক ব্যবসা ফুলে ফেঁপে প্রসারিত হয়েছে। মাদকের ভয়াল থাবা সমাজের সর্বত্র গ্রাস করেছে। এতে যুবসমাজ সাংঘাতিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সমাজ অবক্ষয়ের দিকে জোরালো ভাবে ধাবিত হচ্ছে। মাদকাসক্তরা নেশায় বুঁদ হবার কারণে তাদের মস্তিষ্ক সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকে না। ফলে তারা প্রকৃত মানুষ হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পন্ন হয় না। সব ফিকে হয়ে দেখা দেয়।

আমরা এই লুটেরা শাসক গোষ্ঠীর রাজদন্ডের  ভয়ে কোন অন্যায় – অপরাধের প্রতিবাদ করি না। প্রতিরোধ করি না। আমরা মাথা বন্ধ, চোখ বন্ধ, হাত বন্ধ ও পা বন্ধ করে রাখি। গণবিরোধী শাসকগোষ্ঠী রোবট জনগণ চায়। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষ যখন ক্ষমতার প্রভাব বলয়ে থাকা অপরাধী বা সন্ত্রাসী দ্বারা শারীরিকভাবে আক্রান্ত  হয় তখন আমরা তাদের পাশে এসে দাঁড়াই না। প্রতিবাদও করি না। তদ্রুপ, আমরাও যদি আক্রান্ত হই একইভাবে আমাদের পাশে এসে তারাও দাঁড়ায় না। 

সমাজের বিশাল জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশ শ্রমজীবী মানুষ। এরাই সমাজের ভাসমান অংশ। এদের কোন বাড়ী-ঘর নেই। প্রতিকূল পরিবেশে থেকে, স্বাস্থ্যের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করে শহরে গড়ে ওঠা দরিদ্রপল্লীতে থাকে। একটি ছোট পরিসরের ঘরে ঠাঁসাঠাসি করে তাদের থাকতে হয়। সুস্থভাবে ঘুমাতে পারে না। নিত্যদিন চরম অর্থসঙ্কটে থাকায় বৈদ্যুতিক পাখা অনেক সময় বন্ধ রাখতে হয় । প্রয়োজন মাফিক পুষ্টিসমৃদ্ধ দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটে না। পুষ্টিকর খাবারের চিন্তাই তারা করতে পারে না। প্রচন্ড গরমে আপাদমস্তক দুঃসহ অবস্থায় তারা ঘরে থাকতে বাধ্য হয়। সন্তানদের প্রতিপালন করা দুরূহ হয়ে যায়। তাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে  সম্পূর্ণ অক্ষম। শিশুদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। দুর্গন্ধযুক্ত ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অপুষ্টি নিয়ে বড় হতে হয়। অল্প বয়সী শিশুদের এই পরিবেশে খেলাধুলা করতে হয়। তাদের আনন্দ – বিনোদন সীমাবদ্ধ ও সঙ্কুচিত। শ্রমজীবীরা অসংখ্য ছোট – খাটো পেশার সাথে যুক্ত। পেশা না বলে জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার জন্য জীবিকার পথ বলা যায়। প্রচন্ড রোদ, প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে জীবিকার জন্য পথে নামতে হয়। প্রতিদিন কয়লার মত তাদের শরীর পড়ে । কাঠফাটা রোদে পুড়ে – পুড়ে শরীর সিদ্ধ হয়। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি তাদের জীবন চলার পথ। পথই তাদের জীবিকার জায়গা। অনেক সময় আমাদের চোখের সামনে শ্রমজীবী মানুষের জীবিকার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র অগ্নিরুপ ধারন করে। সমাজ পরিস্কার – পরিচ্ছন্ন করার জন্য এবং আধুনিক, তিলোত্তমা ও সবুজে আচ্ছাদিত মহানগর করার জন্য অভিযান চালিয়ে জীবিকার মূল জায়গা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরী না করে শ্রমজীবীদের উচ্ছেদ রাষ্ট্রের অমানবিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ। আয়ের পথ তৈরী না করে তাদের জীবিকার পথ বন্ধ করার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে তারা গণবিরোধী শক্তি। 

অথচ, আমাদের জীবনযাপনের নিত্যকার প্রয়োজনে বস্তিতে থাকা মানুষদের আমরা ডেকে থাকি। তারা আমাদের প্রয়োজন মেটায়। বস্তি জীবন বাদে আরো অসংখ্য ছিন্নমূল মানুষ আছে – যাদের রাত কাটে খোলা আকাশের নিচে। তাদের আশ্রয় নেওয়ার মত কুড়েঁঘর পর্যন্ত নেই। থাকে পথে – প্রান্তরে, লঞ্চ ঘাটে, রেল স্টেশনে। এদের কোন জীবন নেই। এরা কোন মানুষ নয়। এদের কোন স্বপ্ন নেই। জন্ম হয়েছে আগুনে জ্বলে খাক হওয়ার জন্য। এই পথই তাদের জীবন, এই পথই তাদের সংগ্রাম। এইসব ঘরহীন, আশ্রয়হীন মানুষেরা কীভাবে রাত কাটায় তা কি আমরা একটু ভেবে দেখেছি ?  

সমাজের আরেকটি বিশাল অংশ হলো – পাটকল শ্রমিক। এই শ্রমিকরাই হলো রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। জাতীয় অর্থনীতিকে সচল রাখার ক্ষেত্রে পাটের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। পাট হচ্ছে শ্রমিকের প্রাণ। পাটের অস্তিত্ব না থাকলে শ্রমিকের কোন মূল্য নেই। আবার শ্রমিকের কোন অস্তিত্ব না থাকলে পাটেরও কোন মূল্য নেই। তাই, পাট এবং পাটকল শ্রমিকের সম্পর্ক নিবিড় সম্পর্কযুক্ত। পাট ও পাটকলের জন্য আপাদমস্তক ঘামে ভিজে তারা তাদের সমস্ত কিছু উজাড় করে দেয়। মন্ত্রী, আমলা, সংসদ – সদস্য, সামরিক কর্মকর্তা, পুলিশ, ডাক্তার, সরকারী দফতরের কর্মকর্তা – কর্মচারী, শিক্ষকরা যে বেতন গ্রহণ করেন  তার বড় অংশের জোগান আসে শ্রমিকের উৎপাদিত পাটের আয় থেকে। অথচ, শ্রমিকেরা তাদের ন্যায্য পাওনা সময় মত পায় না। মালিকের লাগামহীন মুনাফার জোগান দিতে গিয়ে কলকারখানায় বহু শ্রমিকের প্রাণ দিতে হয়। তাদের পারিশ্রমিক আদায় করতে যেয়ে অবস্থান ধর্মঘট, আমরণ অনশন, রেলপথ – সড়কপথ অবরোধ, আল্টিমেটাম বা চরমপত্রের মত কঠিন কর্মসূচি ঘোষণা করতে হয়। রক্তচোষা মালিকদের পেটোয়া বাহিনী পুলিশ  শ্রমিকের বুকে গুলি চালায়। শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। এ পর্যন্ত শেষ নয়। শ্রমিকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে নামে – বেনামে মামলা করে। যাতে পারিশ্রমিক আদায়ের আন্দোলন স্তব্ধ করা যায়। এক্ষেত্রে মালিক এবং সরকার একজোট হয়ে আগুনে বাতাস দেন।  

দুর্নীতিগ্রস্থ ও ভীতিকর সমাজে আমরা অন্ধকার ঘরে জীবন্ত লাশের মত বেঁচে আছি। বর্তমান সমাজে দুর্নীতি – অন্যায় – অপরাধ পাগলা ঘোড়ার মত প্রসারিত হচ্ছে। ঠিক এ রকম পরিস্থিতিতে বিশ্বের দেশে – দেশে প্রাণঘাতী নভেল করোনা ভাইরাস ( কোভিড ১৯) ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে – বিশ্বের দেশে-দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা। বিশ্বে ১০০ কোটি মানুষ কর্ম হারাবে। বাংলাদেশ এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। করোনা ভাইরাস মানব দেহ বহন করায় সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি। এই ভাইরাস মোকাবিলায় সরকার কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয় নি। মানুষ যদি মানুষের সান্নিধ্যে আসে তাহলে সংক্রমিত হবার ভয় থাকে। ভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের উদাসীনতা, মনোযোগহীনতা, অবহেলা, শৈথিল্য প্রবলভাবে প্রকাশিত।

রাজশক্তির ব্যর্থতা আড়াল করতে সরকার লকডাউন ঘোষণা করে। কিন্তু এই লকডাউন কোন কার্যকর  লকডাউন নয়। গত ১৬ মার্চ ২০২০ থেকে ৩ মাস ১৫ দিন সাধারণ ছুটির নামে সরকার নাটক মঞ্চায়ন করেছে। এতে প্রতিদিন ৩ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করলে প্রায় দুই লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হয় নি। বাংলাদেশ শ্রমিক – কৃষকের দেশ। কোটি – কোটি শ্রমজীবী – মজুরের দেশ। এই দেশে লকডাউন কার্যকর করতে গেলে ঘরে – ঘরে অর্থ ও খাবার পৌঁছে দিতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টি করতে হলে শুধুমাত্র গণমাধ্যম টেলিভিশনে সম্প্রচার যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট হলে বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন হত। সেক্ষেত্রে গণকর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত ছিল। লোক দেখানো ত্রাণে দুর্নীতি দৃশ্যমান। 

দেশ এখন মহাদুর্যোগের দিকে ধাবিত হচ্ছে। দেশের অসহায় ও নিরন্ন মানুষ বিপৎসংকুল অবস্থায় রয়েছে। তারা কর্মহীনতার কারণে অনাহারে – অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বিস্ফোরক মন্তব্য করতে শোনা যায়। ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হওয়া ক্ষুধার্ত মানুষেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এভাবে মন্তব্য  প্রকাশ করে। তখনও সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারি বরাদ্দকৃত ত্রাণের চাল চুরির ঘটনা ঘটছে। প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকার খবরে জানা যায় – এই সব অপরাধমূলক কাজের সাথে সিংহভাগ যুক্তরাই হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন স্তরের অসংখ্য জনপ্রতিনিধি ও তাদের প্রচ্ছন্ন মদদপুষ্ট ব্যক্তিরা। দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় ত্রাণের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্তরের মানুষ প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।

করোনা পরিস্থিতি কালেও বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের দলীয় নেতাকর্মীরা লুটপাট করার মত লোভ সংবরণ করতে পারছে না। অনাহারী মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত চাল সেটাও মজুদ করতে লজ্জাবোধ করছে না। নিপীড়ক রাষ্ট্রের এই অধঃপতন আজ তলানির এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে এবং রাষ্ট্রের কোথাও কোন জবাবদিহিতা নেই। কাজের নেই কোন স্বচ্ছতা। সঙ্গত কারণে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে সকল অন্যায় – অবিচার, শোষণ – লুণ্ঠন, অমানবিক ও অপরাধমূলক কার্যক্রম প্রকাশ্যে প্রবল প্রতাপে করে যাচ্ছে। যার ফলে – রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দিনের পর দিন তার ন্যায্যতা অবলুপ্ত হচ্ছে।

মহামারী করোনা পরিস্থিতির প্রারম্ভে দেশের সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অচলায়তন বাসা বাঁধে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের কিছুদিন পর অনলাইন শিক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার কিছুটা ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা হয়। যাতে করে প্রতিটি শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষার সাথে যুক্ত থাকে। এ জন্য সরকার পরিকল্পনাটি ঘোষণা করে। আদৌ কী এটা সঠিক পরিকল্পনা ? আদৌ কী এটা বাস্তবায়নযোগ্য ? মোটেই নয়। এই সমাজে অসংখ্য নিম্ন আয়ের মানুষ আছে। এদের পক্ষে অনলাইন শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। অনলাইন শিক্ষার জন্য ব্যয়বহুল আইফোন বা স্মার্ট ফোন ক্রয় করা একেবারে অসম্ভব। ইন্টারনেট সংযোগ ব্যয় সংকুলান করাও তাদের সামর্থ্যের বাইরে। এটা ধ্রুব সত্য যে – মুষ্টিমেয় শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষার সুবিধা পাচ্ছে। আর যারা সমাজের  সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থী তারা সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছে। তারা আমাদের চোখের আড়ালে থেকে যাচ্ছে।

চলমান এই অসুস্থ সমাজ কারা পরিচালনা করছে ? কারা এই অশুভ শক্তি ? যারা রাষ্ট্র ও সমাজের কাছ থেকে অসঙ্গত বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হয়। এরাই রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিষ্ঠিত নিয়ামক ও নিয়ন্ত্রক শক্তি। এদের নিপীড়ন ও নিষ্পেষণের শিকার  সুবিধাবঞ্চিত মানুষ সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে না। নিরাপদে চলতে পারে না। সমাজে সুবিধাপ্রাপ্ত নিয়ন্ত্রকেরা অন্যায় – অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকে। শ্রমিক – কৃষক – মজুর তথা সাধারণ জনগণকে শোষণ – নির্যাতন – নিপীড়ন করে। জনগণের বাক – স্বাধীনতা হরণ করে, প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করার অপচেষ্টা চালায়। জনগণের সম্পদ অবৈধভাবে লুণ্ঠন করে। অবৈধভাবে বিপুল অর্থের পাহাড় গড়ে তোলে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে টাকার কুমির বনে যায়। কোটি – কোটি টাকায় নির্মিত প্রাসাদ বা সুরম্য অট্টালিকায় বসবাস করে। সামান্য গরমে এদের জীবন ওষ্ঠাগত হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া চলতেই পারে না। বিলাস বহুল গাড়িতে চলাফেরা করেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার চাদরে তাদের মোড়ানো থাকে। অন্যায়ভাবে নিরংকুশ  সুবিধা নেওয়ার জন্য ক্ষমতায় থাকতে চায়। জনগণকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়। জবরদস্তিমূলকভাবে সিংহাসন দখলে রাখতে চায়।

সমাজব্যবস্থার অচলায়তন কী এভাবে থেকে যাবে?  সমাজের আদৌ কী কোন পরিবর্তন হবে না ? এভাবেই কী আমরা সমাজকে দেখে যাব ? হয়তোবা অনেকেই মনে করেন – সমাজ এভাবেই থেকে যাবে। তাহলে কীসমাজ পরির্বতনশীল নয় ? নিশ্চিতভাবে বলা যায় – সমাজ পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় সমাজ বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। তবুও সমাজের গুণগত পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। তাহলে প্রতিবন্ধকতা কোথায় ? প্রতিবন্ধকতা আমাদের ভেতরেই বিদ্যমান। আমরাই পারি পরিবর্তন ঘটাতে। আমাদের উপলব্ধি করা উচিত – রাজনীতি আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। রাজনীতিই পারে সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে। রাজনীতিই পারে নিপীড়ক রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটাতে। পরিবর্তনের নিয়ামক রাজনীতি হলে আপনার নির্দিষ্ট করতে হবে – আপনি কোন রাজনীতি করবেন ? সুবিধাবঞ্চিত সাধারণ জনগণের নাকি লুটেরা শাসকগোষ্ঠীর ? নাকি নিরাপদে থাকার খোঁড়াযুক্তি দেখিয়ে উভয় রাজনীতির বাইরে থেকে স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন ? আপনারা যদি রাতে কুম্ভকর্ণের মত ঘুমিয়ে থাকতে চান – তাহলে কোনদিন রাত পেরিয়ে ভোর হবে না। নতুন দিনের সূর্যোদয় দেখা যাবে না। খুব ছোটবেলায় পাঠশালাতে একটি কবিতা পড়েছি। কবিতাটির নাম – আমি হব সকাল বেলার পাখি। লিখেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কবিতার দুটি চরণে কবি উল্লেখ করেছেন – আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে। তোমার ছেলে উঠলে মা গো , রাত পোহাবে তবে।

কাক ডাকা ভোরে আমরা যদি ঘুমিয়ে থাকি , সকালের রোদ বাড়তে থাকার পরও ঘুমিয়ে থাকি – কোনদিন নতুন দিনের আলো দেখতে পাবো না। দিনের বেলায় রাতের আধার ভেবে ঘুমিয়ে থাকতে হবে। আমরা যদি নতুন চিন্তা, নতুন  ভাবনা, নতুন  কাজকে আলোকিত করতে চাই তাহলে কাক ডাকা ভোরে উঠতেই হবে। নিজেদের সুবিধাপ্রাপ্তির জন্যেই সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ জন্য জনগণের রাজনীতি বিকাশে তার নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ , সুন্দর, নিরাপদ ও বাসযোগ্য সমাজ – দেশ – পৃথিবী গঠন করতে গেলে আমাদের সচেতন হতে হবে। ভয়কে জয় করতে হবে। প্রতিবাদী হতে হবে। নিজেদের মধ্যে অধিকারবোধ জন্মাতে হবে। ঘুণেধরা সমাজের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তবেই তো আমাদের সমাজ বাসযোগ্য হবে। গণবিরোধী শাসনব্যবস্থা উচ্ছেদ হবে। লুটেরা শাসকগোষ্ঠী আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পাবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি,  পরিবর্তন সম্ভব আমরা পরিবর্তন চাই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য সমাজ বিনির্মাণের জন্য আমরা এই দায়িত্ব নিতে পারি না ? সমাজের আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে আমরা সেই সংগ্রামের ডাক দিয়ে যাই।

মুনীর চৌধুরী সোহেল
আহ্বায়ক, গণসংহতি আন্দোলন, খুলনা
১৩.০৯.২০২০

Leave a Reply