You are currently viewing সর্বনাশা ছুটি!
করোনা আতঙ্কে মানুষজনের ঢাকা ছাড়ার প্রতীকি ছবি - গণসংহতি আন্দোলন

সর্বনাশা ছুটি!

লক ডাউন আর ছুটির পার্থক্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর যা ফারাক, তার ফলাফল আসমান-জমিনের পার্থক্য ডেকে আনবে। হয় সরকার জেনে বুঝে এই কাজ করেছে, কিংবা এত নির্বোধ যে, এর তাৎপর্য বুঝতে পারেনি।

লক ডাউনের সোজা মানে হলো যে যেখানে আছো, বসে থাকো। তোমাদের খাবার, তোমাদের সরঞ্জামাদি, তোমাদের চিকিৎসা সব কিছুর দায় রাষ্ট্র/কর্তৃপক্ষ/হাসপাতাল/পৌরসভা নেবে।

এটা করা হয় যাতে যে কেউ সংক্রমিত হোক বা না হোক, সে যেন অন্যের সংক্রমণের কারণ না হয়, কিংবা নিজেকে সংক্রমিত না করে। মানুষজন স্থির থাকার মানেই হলো রোগের জীবানু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবে না, একের শরীর থেকে অন্যের শরীর আক্রান্ত হবে না। লক ডাউন ঘোষণা করা হলে নাগরিকদের প্রধান ও একমাত্র দায়িত্ব নিজের জায়গায় থাকা। বাইরে না যাওয়া। ঘন-ঘিঞ্জি-কোলাহলপূর্ণ সব জায়গা এড়ানো। দেখবেন কদিন আগে একটা শিরোনাম খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, ‘ধন্যবাদ, প্যারিসবাসী, ভাইরাসটা নিয়ে এসো না’: গ্রামীণ ফ্রান্সের আবেদন।
(‘Thank you Parisians, don’t bring the virus’: plea from rural France)

লক ডাউনের সময়ে প্রতিটি নাগরিক একটা জরুরি অব্সথা/আপৎকালীন অবস্থায় থাকেন। তার ব্যক্তিস্বাধীনতা খানিকটা খর্ব করা হয়। কিন্তু তাকে এই নিশ্চয়তাও দেয়া হয় যে, তার জীবন-সম্পদ রক্ষা, তার ভরণপোষণের সাময়িক দায়ও কর্তৃপক্ষ নিচ্ছে। পরিবহন বন্ধ তো থাকেই, পায়ে হাঁটাও সীমিত করা হয়। অনুমতি ছাড়া বাইরে গেলে জরিমানা।

করোনা আতঙ্কে মানুষজনের ঢাকা ছাড়ার প্রতীকি ছবি - গণসংহতি আন্দোলন
করোনা আতঙ্কে মানুষজনের ঢাকা ছাড়ার প্রতীকি ছবি – গণসংহতি আন্দোলন

অন্যটা হলো ছুটি। ছুটির সময়ে আপনি স্বাধীন। আপনাকে কোন বাধ্যতামূলক নির্দেশনা দেয়া হয়নি আপনি বাসায় থাকবেন, না বাড়িতে যাবেন। আপনার খাবার কে জোগাবে, তাও এর মাঝে বলা নাই। আপনার চিকিৎসার নিশ্চয়তা নাই। এবং খুবই সম্ভাবনা আছে যে, আপনার পরিচিত একটা বড় অংশ এর আগেই বাড়ি চলে গেছে। এখনও পরিবহন সরকার চালু রেখেছে, সে তো কোথাও যাবার জন্যই!

তখন আপনি কি করবেন? অনাত্মীয়, ভরসাহীন এই শহরে থেকে যাবেন, না কি আপনার পরিচিতদের মাঝেই যাবার চেষ্টা করবেন?

মানুষের আচরণগত দিক দিয়ে বিবেচনা করলে চলে যাবার চেষ্টা করাটাই স্বাভাবিক, এবং সঙ্গত। এমনকি ছুটি ঘোষণার আগেও যাদের পক্ষে সম্ভব, একদল মানুষ গ্রামে চলে গেছেন। কেউ কেউ উপায়হীন হয়েও গেছেন। তাদের মাঝে দরিদ্রতর মানুষের সংখ্যা বেশি, স্বচ্ছলরাও আছেন খুব নগণ্য।

সাধারণ ছুটির ফলে খেয়াল করুন, বড় শহরগুলো ফাঁকা করে সুস্থ/অসুস্থ, বাহক/স্বাভাৃবিক সকলে একযোগে গ্রামের বাড়ি চলে যাবেন। এইভাবে যারা যাবেন, তারা খাঁটি শহুরে না। বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের শহরে নিজেদের অসংক্রামিত বা নিরাপদ রেখে টিকে থাকার উপায় বেশ কম। সরকার তো এখনো কোন ভরসা দেয়নি যে তাদের দায় গ্রহণ করবে।

এর ফলাফল হলো শহরটা ক্ষমতাবিন্যাসের দিক দিয়ে সক্ষমতরদের জন্য ফাঁকা হলো। আবারও ওপরে বলা একটা কথায় আসি: যত কম নড়াচড়া, তত কম সংক্রমণ। এর সাথে যুক্ত করুন: যত কম মানুষ, তত কম সংক্রমণ।

সকল মানুষের দায় যখন গ্রহণ করতে পারবেন না,তখন এটা একটা চরম স্বার্থপর কিন্তু কার্যকর কৌশল হতে পারে নাগরিকদের ওপর তলার অংশটাকে নিরাপদতর রাখার একটা চেষ্টা হিসেবে।

রাষ্ট্রের তো সকলের দায় নেবার কথা ছিল? বেশ, সেটা গণতন্ত্রে হয়ে থাকে। দুঃসময়ে সত্যকে প্রকৃত চেহারায় চেনা যায়।

হয়তো সরকার যারা চালায়, যারা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা এই চরম স্বার্থপর চিন্তা থেকেই মানুষকে ছুটি দিয়ে ঠেলে দিয়েছে গ্রামের দিকে। ফলে এটা ছুটিতে ছোটা নয়, ছুটির ঠেলায় ছুটতে বাধ্য হওয়া।

এবং খেয়াল করুন: মোসাহেবদের পক্ষে কতটা সহজ হলো এই ছুটন্ত মানুষের বেকুবিকেই সংক্রমণের চরম জায়গায় যাবার কারণ হিসেবে, সরকারের ব্যর্থতার ঢাল হিসেবে হাজির করা!

মানুষজন চলে গেলে এরপর হয়তো বাহিনীগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে যাতায়াতের পথ। লক ডাউন আসবে। সহজে কেউ ফিরতে পারবে না যতক্ষন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। অথবা হয়তো অতটা কড়াকড়ির আর দরকর হবে না। কাজ শুরু না হলে এই মানুষদের পক্ষে পরিজন নিয়ে ফেরাটাও কঠিন হবে।

সুদূর গ্রামে তো মানুষ মারা যাবে শ্বাসকষ্টে এবং নিউমোনিয়ায়। শহরে চিকিৎসার চাপ কমে গেলে হয়তো আরেকটু বেশিবেশি সংখ্যায় পরীক্ষা করে জানা যাবে রোগী করোনা আক্রান্ত কি না।

গ্রামে কি আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কম? একদম না। গ্রামগুলোর বিচ্ছিন্নতা শহরের চাইতে অনেক কম, যদি তার চারিদিকে খোলা প্রান্তর থেকেও থাকে। সেখানে পুকুর সংক্রমণের উৎস হতে পারে, প্রত্যেকের পৃথক পানির পাত্র না থাকাটা সংক্রমণের উৎস হতে পারে, একসাথে বিপুল মানুষের থাকার আয়োজন না থাকাটা সংক্রমণের উৎস হতে পারে। বহুদিক থেকে বহু মানুষ এসেছেন বলে সংক্রমণ ঘটতে পারে। সবচেয়ে ভয়াবহ হবে এই ছুটিতে বাড়ি যাবার পথটা, সেটা সংক্রমণের উৎস হতে পারে।

রাজনৈতিকভাবেও হয়তো এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য সহজ হবে। নগরে বিক্ষোভ দমন কঠিন। গ্রামে এবং মফস্বলে সহজতর।

খুবই সম্ভাবনা আছে সরকার এত জটিল কিছু না ভেবে এই ছুটি দিয়েছে। এই সরকারের নির্বোধ কাজকারবার নিয়ে একটা অভিসর্ন্দর্ভ তৈরি হতে পারে। আবার খুবই সম্ভব, অসম্ভব চতুর জনাকয়েক আছেন এখানে, যারা হয়তো দেশটাকে সর্বনাশা ছুটির ছোটাছুটির ফাঁদের দিকে ঠেলে দিলো।

লেখক: ফিরোজ আহমেদ
লেখককে ফেসবুকে ফলো করুন 

Leave a Reply