You are currently viewing মুল্লুকে চলো আন্দোলন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে চা শ্রমিক

মুল্লুকে চলো আন্দোলন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে চা শ্রমিক

১৮৩৪-৩৫ সালে চা-শ্রমিকরা ব্রিটিশ চা বাগান মালিক কর্তৃক অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ১৯২১ সালের এই দিনে নিজ মুল্লুকে (আবাসভূমিতে) ফিরে যাবার জন্য “মুল্লুকে চলো আন্দোলন” সংগঠিত করেছিল। তারা পায়ে হেঁটেই সিলেট থেকে চাঁদপুরের মেঘনা ঘাঁট পর্যন্ত আসে। এখানে ব্রিটিশরা তাদেরকে বাঁধা দেয়। বাঁধা অতিক্রম করে চা-শ্রমিকরা মেঘনা নদী পার হয়ে নিজের মুল্লুকে যেতে চাইলে ব্রিটিশ গুর্খা বাহিনী তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং হাজার হাজার চা-শ্রমিককের পেট কেটে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। চা-শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয় মেঘনা নদীর পানি।

চা-শ্রমিকদের রক্তেমাখা এই ইতিহাসকে স্মরণ করার জন্য প্রতি বছর ২০ মে পালিত হয় “চা-শ্রমিক হত্যা দিবস”।

প্রসঙ্গত, ইংরেজরা অতি কৌশলের মাধ্যমে আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে (গাছ হিলায়ে গা তো পাইসা মিলেবে- গাছ নাড়লে টাকা মিলবে) ১৮৩৪ সালের দিকে ১১৬ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে শ্রমিক হিসেবে সংগ্রহ করে। কিন্তু চা-শ্রমিকরা এ অঞ্চলে এসে দেখে গাছ নাড়লে টাকা পাওয়া তো দূরের কথা হিংস্র জীব-জন্তুর প্রতিকূল পাহাড় জঙ্গলময় পরিবেশে নিজের জীবন বাঁচানোই দুঃসাধ্য ব্যাপার। অনাহারে-অর্ধাহারে অসুখে-বিসুখে এক বীভৎস জীবনের সম্মুখীন হয়েছে তাঁরা। সে সময় আড়কাঠি ও গিরমিট প্রথার কারণে চা ম্যানেজার এই অসহায় মানুষগুলোর ওপর একচ্ছত্র নির্যাতন করার অধিকার পায়। কোন শ্রমিক ইচ্ছে করলেই চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে পারতো না। বাগান থেকে পালিয়ে গেলে তাদের ধরে আনা হতো। দেয়া হতো অমানবিক শাস্তি যা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো না। চাবুক বুটের লাথি ছিল এই নিরীহ মানুষগুলোর নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এভাবে মালিকদের হাতে শ্রমিকের মৃত্যুকেও সাধারণ ঘটনা হিসবে দেখা হতো।

পুরুষ শ্রমিকদের বেতন চার আনা, মহিলাদের বেতন তিন আনা এবং শিশুদের বেতন দুই আনা। তখন চা বাগানে শিশু শ্রম বৈধ ছিল; এখনও আছে।

চা রপ্তানির জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ১৮৬৪–৬৫ সালে রেল লাইন স্থাপন করে এবং প্রসারিত করে ১৯০৪ সালে চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত করে। ফলে বাহির থেকে শ্রমিক আমদানি অনেক সহজ হয়ে যায়।

রেলস্টেশন থেকে পণ্ডিত গঙ্গা দয়াল দীক্ষিতসহ নেতৃস্থানীয় শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। জেলখানা কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে পণ্ডিত গঙ্গা দয়াল দীক্ষিত অনশন করে প্রাণ বিসর্জন দেন।তারপর কি হয়? তারপর রাজনীতি।

১) এ মর্মান্তিক ঘটনার পরও যেসব শ্রমিক নিজ মুল্লুকে যতে একান্ত ইচ্ছুক, কোম্পানি তাদের যাবার ব্যবস্থা করবে।
২) কিছু কংগ্রেস কর্মী গিয়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে।
৩) বাকীরা আসামে ফিরে গিয়ে আবার কাজ পাবে।
৪) কোম্পানি তাদের কাজ পেতে কোন অসুবিধার সৃষ্টি করবে না।
ছেলে ভোলানো চার দফার আপোষের মাধ্যমে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। সম্প্রতি চা শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করার পর বাংলাদেশ সরকারও তাদের সাথে রসিকতা করেছে।

চা বাগানে শিশু শ্রম: দেখার কেউ নেই

বাংলাদেশের প্রতিটি চা বাগানেই শিশু শ্রমিক নিয়োজিত আছে যেখানে বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী {অধ্যায় ৩, ধারা-৩৪(১)} শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী (অধ্যায় ২, ধারা-৫) চা বাগান কর্তৃপক্ষ কাজে নিয়োগদানের পূর্বে একজন চা শ্রমিককে নিয়োগপত্র দিতে বাধ্য। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের কোন চা শ্রমিককে নিয়োগপত্র দেয়া হয় না।আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে ১১৬ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে শ্রমিক হিসেবে সংগ্রহ এ অঞ্চলে নিয়ে আসা হয় । যাদের প্রত্যেকের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, ধর্মীয় রীতিনীতি, পূজা-উৎসব, বিবাহপ্রথা, সমাজ কাঠামো দেশের মূল ধারার জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। নৃ-তাত্ত্বিক সংজ্ঞানুসারে চা জনগোষ্ঠীর কেউ প্রাক-দ্রাবিড়ীয়, কেউ আদি অষ্ট্রালয়েড, কেউবা মঙ্গোলীয় আদিবাসীর অন্তর্ভুক্ত।কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত তো দে-ই নি, এমনকি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর তালিকায়ও এদেরকে অন্তর্ভুক্ত করেনি, যে কারণে এরা কোটা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বরঞ্চ এদেরকে অন্তর্ভুক্ত করলে এরা দেশের সরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও চাকুরি ক্ষেত্রে নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারতো এবং নিজেদের দুরবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারতো। চা চাষের জন্য সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট মেয়াদে ১,১১,৬৬৩.৮৩ হেক্টর জমি লীজ মঞ্জুর করে যার ৫১.১১ % জমিতে চা চাষ করা হয়। একর প্রতি বাৎসরিক লীজের পরিমাণ ৫০০ টাকা। অপরদিকে প্রতি একর কৃষি জমি ব্যবহারের জন্য চা শ্রমিকদের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে ৩ কেজি রেশন কর্তন করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক এই লীজ দেখভাল করেন। চা-শ্রমিকরা দীর্ঘ ১৮০ বছর ধরে চা বাগানে বসবাস করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা ভূমির অধিকার পায় নি – তারা যেন “নিজভূমে পরবাসী”।

চা বাগান মালিক কর্তৃক নির্ধারিত ঘর (৮ ফুট/১২ ফুট) ব্যতীত ঘর নির্মাণ করতে চাইলে বেশির ক্ষেত্রেই অনুমতি দেয়া হয় না। ভূমির অধিকার না থাকার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। ভূমি অধিকার না থাকার কারণে চা শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত জমি দখলের শিকার হচ্ছে। সরকার, চা-বাগানের মালিক, প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে সাধারণত চা শ্রমিকরা জমি দখলের শিকার হয়। চান্দপুর-বেগমখান চা বাগানের ১২৫০ টি চা শ্রমিকদের পরিবারের ৫১১.৮৩ একর কৃষি-জমি দখল করে সরকার “বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল” করছে। এই জমি দখল করার পূর্বে সরকার চা শ্রমিক পরিবারগুলোকে কোন প্রকার পুনর্বাসন, ক্ষতি-পূরণ দেয়া তো দূরের কথা তাদের সাথে কোন আলোচনাও করে নি। তার কারণ একটাই চা শ্রমিকদের ওই জমির কোন কাগজ-পত্র নেই।

লাখাই চা বাগানের ৭০ টি চা শ্রমিক পরিবারের প্রায় ১০০ একর কৃষি জমি দখল করে চা-বাগান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক চা গাছ লাগানো হয়েছে। লাক্কাতুরা চা বাগানের চা শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ না দিয়েই তাদের জমিতে প্রভাবশালী মহল কর্তৃক নির্মিত হয়েছে সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম।

জমি দখলের এ রকম চিত্র প্রায় প্রতিটি চা বাগানেই দেখা যায়। কোন চা শ্রমিক পরিবার চা বাগানে কাজ না করলে তাকে চা বাগান থেকে উচ্ছেদ করে দেয়া হয়।নিজভূমে পরবাসী এই চা শ্রমিকরা চার প্রজন্ম ধরে বসবাস করেও চা বাগান থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি (কমপক্ষে ২৫০ টাকা), বিদ্যমান ভূমিসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধান এবং চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন অতীব প্রয়োজন। চা-শ্রমিকদের নিম্নলিখিত দাবী আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চা বাগানে আন্দোলন সংগ্রাম চলছে। তাদের দাবিসমূহঃ

১. চা বাগানে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা
২. দেশের সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি চাকুরীতে কোটা সংরক্ষণ করা
৩. চা জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য একটি কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা
৪. শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, কারিগরি বিদ্যালয়, কলেজ প্রতিষ্ঠা
৫. চা বাগানের বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে একটি কমিশন বা মন্ত্রণালয় গঠন করা
৬. চা বাগান এলাকায় পর্যাপ্ত সরকারিব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা ।

দাবিগুলোর দিকে লক্ষ করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, চা-শ্রমিকরা বিশেষ কোন সুবিধা চাচ্ছেন না। কার্যত মৌলিক অধিকারগুলো পাওয়ার চেষ্টা করছেন।

স্বাধীন একটা দেশে আপনারা শ্রমিকদের নূন্যতম নাগরিক অধিকার দেবেন না। গার্মেন্ট, চা শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার অনাচার নিয়ে কোন কথা না বলেই, আধুনিক সভ্য জাতিরাষ্ট্র চাইবেন? এরকম হয় না প্রিয় সহ-নাগরিকবৃন্দ। কথায় কথায় অসভ্য না বলে, সভ্য নাগরিকের মর্যাদা দেয়ার কথা বলুন।


#জ/উম-৫/১২

Leave a Reply