You are currently viewing যৌন নির্যাতনের শিকার গার্মেন্ট শ্রমিক ও বাংলাদেশী নারীবাদ

যৌন নির্যাতনের শিকার গার্মেন্ট শ্রমিক ও বাংলাদেশী নারীবাদ

নির্যাতিত গার্মেন্ট শ্রমিক ও নারীবাদের গতি-প্রকৃতি বাংলাদেশ পুলিশের নারী নিপীড়ন ও বাংলাদেশের নারীবাদী মনস্তত্ত্বের গতি প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করবো এখানে। বাংলাদেশ পুলিশের নারী নিপীড়নের নিকট ইতিহাস বলতে আমি দিনাজপুরে ইয়াসমিনকে ধর্ষন করে হত্যার কথা মাত্র স্মরণ করতে পারি। কিন্তু এখানে যে দুইটি নারী নিপীড়ন নিয়ে কথা বলবো তাতেও অভিযুক্ত পক্ষ পুলিশ। তবে বাদী সামাজিক ক্ষমতা কাঠামোর দুই বিপরীত প্রান্তের মানুষ। পয়সা ও শিক্ষায়, চেহারা ও শ্রমে, মর্যাদা ও অমর্যাদায়। সরকারি- বেসরকারি সামাজিক বা গণমাধ্যমের ভূমিকাও তাদের ক্ষেত্রে একরকম নয়। ভিকটিম দুইজন এক শুধুই লিঙ্গীয় পরিচয়ে।

নিপীড়নের ঘটনা-১ঃ স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে। পহেলা বৈশাখের দিনে, এই লেখক আলোচিত ভিকটিম সহ আরোও ১০-১২ জন ২০১৬ সালের ১৪ এপ্রিল বৈশাখি মেলার গান শুনতে ভিড় করেছিলাম। তখন ঐ পথে কোন এক কেবিনেট সদস্য যাচ্ছিলেন বলে পুলিশ আমাদের সরে যেতে বলে। আমরা সরেও যাচ্ছিলাম। এমন সময় পুলিশ ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতি হাবিবা জান্নাতের গায়ে হাত দেয় ও অশ্লীল গালি দেয়। আমরা জানার সাথে সাথে ঐ পুলিশ সদস্যকে ধরে ফেলি। চাপে পরে পুলিশ প্রকাশ্যে হাত জোর করে ক্ষমা চায়। নীপিড়ক পুলিশ সদস্যকে ক্লোজ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে পুলিশ কর্মকর্তা (অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে) লিখিত আশ্বাস দিলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসি। এখানেই শেষ নয়। প্রক্টর অফিসে যাওয়ার আগে অসংখ্য মিডিয়ায় হাবিবার বক্তব্য নেন, প্রক্টর উপস্থিত হন। তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল প্রচারিত হয় প্রধান সব ইলেকট্রিক মিডিয়ায়। রাতে টিভি টকশোতে কথা বলেন হাবিবা। একটা নিউজ পোর্টাল তার পরের দিন হাবিবার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। এসব সম্ভব হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিনের সংগঠন চর্চার ফলে, নারীর ক্ষমতায়ন কিছু মাত্রায় অর্জিত হয়েছে বলেই।

habiba jannat Ganosamhati
ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক
সহ-সভাপতি হাবিবা জান্নাত

পুলিশ প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন

নিপীড়নের ঘটনা-২:  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরেই জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ৮০ দিন ধরে ১১ মাসের বেতনের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন “এ ওয়ান” ও “তাজরিন ফ্যশনের” শ্রমিকরা। এ আন্দালনে পুলিশ দফায় দফায় বাধা দেয়া স্বত্বেও শ্রমিকরা শ্রমমন্ত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমনকি মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর বেতন ও ক্ষতিপূরনের দাবিতে স্মারকলিপি দেয়। একেবারে যাকে বলে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। তারমানে সরকার আন্দোলন ও আন্দোলনের দাবি পরিস্কারভাবে জানতো। তবুও তাদের বকেয়া বেতন দেয়ার কোন ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, উল্টো ৭ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ ভোরের আগে অন্ধকারে পুলিশ জলকামানের সাহায্যে গরম-ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে, ওড়না কেড়ে নিয়ে, লাঠিচার্জ করে উচ্ছেদ করেছে, ময়লা সাফের মতো করে ছত্রভঙ্গ করেছে। এতেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, ক্ষমতার গরমে উর্দি পরা বাহিনীর সদস্যরা শ্রমিকদের ভাষ্যমতে, নারী শ্রমিকদের গায়ে হাত দিয়ে যৌন হয়রানি করেছে, মোবাইল-জামা কাপড়-টাকা পয়সা সমেত ব্যগ কেড়ে নেয়া হয়েছে। এতোসব করেও ”মুজিব বর্ষের অঙ্গীকারে জনতার হয়ে ওঠা ” পুলিশ ক্ষান্ত হতে পারেনি। শেষ রাতের আরামের ঘুম ভেঙ্গে একশনে আসার ক্ষোভে তারা শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “বেশ্যারা ব্যবসা পাইছোস?” ভাবতে পারেন এই পুলিশরা আমাদের কারো না কারো আত্মীয়, এই শ্রমিকদের কেউই তাদের কারোও কারোও স্বজন হওয়াটাই স্বাভাবিক।

সেদিন দুপুরেই আবার বিক্ষোভ সমাবেশ করতে গেলে পুলিশ দেখে উত্তেজিত হয়ে এক মধ্যবয়সী নারী,  পাহাড়াদার পুলিশকে উদ্দেশ্য করে আক্ষেপে কুত্তার বাচ্চা, কুত্তার জন্মানো, শুয়ারের বাচচা বলে গালিগালাজ করে ওঠেন। মধ্যবিত্ত নেতৃবৃন্দের শেখানো শ্লোগান আর শুদ্ধ বাক্যে তার অপমানের জ্বালা মিটছিলোনা। গালিগালাজ করার সময় তাকে অসহায় কাঁদতে দেখা যায়। মজলুমের এই কান্না শ্লীলতাহানির, এই কান্না সুবিচার না পাওয়ার। এ কান্না অসহায়ত্বের। তাদের আল্লার কাছে বিচার দিতে দেখা যায়। তবে এই  দ্বিতীয় ঘটনাটির কোন কিছুই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ‘নিউজ ভালু’ তৈরী করতে পারেনি। ( এখানে ভিডিও দেখুন )।

এর আগে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সন্মেলনে শ্রমিক নেতারা দেশবাসীর কাছে বিচার দেন। দেশবাসী তাদের অভিযোগ আমলে নেয়ার সুযোগই পাননি। কারন ভাস্কর্য্য ইস্যু সামলাতে আর ভাইরাল রাজশাহী ধূমপান নিয়ে গুন্ডামির ঘটনায় সামাজিক মিডিয়ার সকল ”আদালত” শুনানিতে ব্যস্ত ছিলেন। যদিও রাজশাহীর ভিক্টম নারী দেশবাসীর কাছে বিচার চান নাই। সামাজিক মাধ্যমে জেনেছি, রাজশাহীর ভিক্টিম নারী (সম্ভবত ক্ষমতাবান) সরাসরি থানায় অভিযোগ করেছেন। আমি চাই রাজশাহীর ঐ গুন্ডাটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক। অন্যদিকে শাহবাগ থানায় বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর নেতা দিলিপ রায় অসহায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের লুটে নেওয়া ব্যাগগুলো ফেরত চাইতে গেলে তাকে জোর গলায় জানানো হয়েছে, ”গত ভোররাতে প্রেসক্লাবে এমন কোন ঘটনা ঘটে নাই। ”

 গরীব শ্রমিকদের মান-সন্মান, শ্লীলতা বা গ্ল্যামারহীন অবয়ব হয়তো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আম দর্শকদের আকৃষ্ট করেনা, উদ্বেগে ফেলে না। কিন্তু নারীবাদীদের ক্ষেত্রেও কি তাই? ব্যারিস্টার মঈনুলের দেয়া এক শব্দের গালি যে নারীবাদীদের (এরা নারীবাদী নন। নারীবাদের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম আছে। এদের তথাকথিত নারীবাদী বলা যায়।) রাগিয়ে দিয়েছিলো তাঁরা ক্ষমতা কাঠামোর খুব উচুতে হয়তো অবস্থান করেন। তাঁদের কানে ‘অসুন্দর’ ‘ক্ষমতাহীন’ গার্মেন্ট শ্রমিকদের কান্নার শব্দ হয়তো পৈাছাতে পারেনি। তারা এনজিও সংশ্লিষ্ট নারীবাদীরা শুনলেও শুনে থাকবেন হয়তো, তারাও নারী ক্ষমতায়-স্বাস্থ ইত্যাদি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেও এরকম নারকীয় ঘটনার পর তাদের কোন বক্তব্য আমার চোখে পরেনি। আমার কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নাই। আপনি আপনার সুবিধা মতো কথা বলেন। যেহেতু এখন কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে “কথা বললেই চাকরি থাকবে না” সুতরাং ঝুঁকি এড়িয়ে কথা বলার বা না বলা যাচ্ছে না। এমনকি সামাজিক মাধ্যমে তুলনামূলক তরুণ নারীবাদীরা বেশ উচ্চকিত থাকেন, তারাও এতো বড় যৌন নিপিড়নের ঘটনায় কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। এও হতে পারে, তীব্র ধর্ষণ চলমান থাকায় তাদের নার্ভ শক্ত হয়ে গিয়েছে, সংবেদনশীলতা কমে এসেছে। এমনও হতে পারে যে, এ বিষয়ে আদৌ তাদের কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। আমরা কেউই তো আর প্রতিবাদ করতে বাধ্য নই।

তবে আমরা সবাই কথা না বললে নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। তবে বিনয়ের সাথে বলতে চাই, আপনি বা আমি যে ধরনের নারীবাদেরই চর্চা করিনা কেন নিজের কাছে দায়বদ্ধ থাকাটা খুব জরুরি। আপনার আমার ‘বাছাই করা প্রতিবাদের’ সামাজিক প্রভাব আছে। সেটা সমাজদেহের ভিতরে গভীর অসন্তোষ তৈরি করে, সংহতিতে ফাটল ধরায়। সামাজিক মাধ্যমে নারীবাদী শব্দটা গালি হয়ে ওঠার পেছনে প্রধানতম কারণ পুরুষতন্ত্র হলেও, এরকিছু দায় নারীবাদীদের সিলেক্টিভ এ্যক্টিভিজমের বা ডাবল স্টান্ডার্ডের । সমাজের সাধারণ মানুষ যখন তথাকথিত সিলেক্টিভ ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত নারীবাদী চর্চা দেখেন তখন বেশিরভাগ মানুষের বোধগম্য হয় যে, তারা নিজেদের সুবিধার্থে “নারীবাদের” চর্চা করছেন। সামাজিক মাধ্যমে দেখবেন শুধু নারীবাদী না রাজনীতিবিদ, আইনজীবী আমলা সকলের এক বিশেষ রকম ’ইমেজ’ প্রচলিত আছে। তাদের কথা বাদ দেই, যে গার্মেন্ট শ্রমিকরা পুলিশের দ্বারা নারী নির্যাতনের শিকার হলেন তাদের প্রায় সকলেই টিভি দেখেন। ”অভিজাত” বা বিশেষ নারী নির্যাতনের পর টিভিতে যখন আপনাদের উচ্চকিত স্বর শুনবেন তখন তিনি আপনার সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করবেন? গার্মেন্ট শ্রমিকদের সন্তানেরা যখন আপনাকে তার মায়ের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলতে শুনবেনা তখন আপনার নারীবাদ সম্পর্কে তার আগ্রহ তৈরী হবে না বরং বিদ্বেষ তৈরী হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এক্ষেত্রে যারা নারীবাদ চর্চা করেন তাদের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আসলে আমরা মুখে যা বলি আদতে আমরা তা নই। আমরা যা করি সেটাই আমাদের ইমেজ তৈরী করে সমাজে, আর আমরা সেটাই। সুতরাং স্বীয় কার্যক্রম, এ্যাক্টিভিজমের মূল্যায়ন, সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন খুব প্রয়োজনীয়।  

ফেরা যাক প্রখম ঘটনায়। হাবিবা নিজেই সুবিধা প্রাপ্ত অংশের মানুষ ছিলেন, ছাত্র ফেডারেশনের নেতা, সাথে একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। তার নেতারা জানেন, নারী স্বাধীন নাহলে পুরুষের মুক্তি নাই। আরো ছিলো প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া। তাঁর পক্ষে বিচার চাওয়া ও পাওয়া তূলনামূলক সহজ। আমরা এই সামাজিক সুবিধা শ্রেণীগত কারণে পেয়ে থাকি। অন্যদিকে এই গার্মেন্ট শ্রমিকরা মাত্র সংগঠিত হচ্ছে। তাদের এখনও ছাত্রদের মতো শক্তিশালী কোন সংগঠন নাই। তবে পুলিশ দেখে উত্তেজিত হয়ে গালি দেয়াটা তাৎপর্যপূর্ণ। তারা সাহস সঞ্চয় করে ফেলেছেন। তারা প্রয়োজন হলে থানা ঘেরাও করবেন। তারা প্রবলভাবে সংগঠিত হবেন, পাটকল বা চিনিকলের শ্রমিকদের মতো। পাটকল শ্রমিকরা বাংলাদেশের অভূদ্যয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্রদের সাথে মিছিল করেছেন। মধ্যবিত্তের মতো মানসিক সংকট বা ডাবল স্টান্ডার্ড শ্রমিকদের নেই। গার্মেন্ট শ্রমিকরা সকল শ্রেণীর নারীদের মানবিক সকল প্রকার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। শুধু নারী প্রশ্ন নয়, মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের অনাচারে লুটপাটে ভাগাড় হয়ে ওঠা এই রাষ্ট্র বিনির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ ঘটবে শ্রমিকদের হাত ধরেই। 

বিদেশী বেগমপাড়া বা উন্নত দেশে তৃতীয় শ্রেণীর অভিবাসন নয়, বরং চলুন নিজেদের আত্মমর্যাদা ও জাতীয় সক্ষমতার দিকে ফিরি। আমাদের (মধ্যবিত্তের) প্রতিদিনের  অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য গার্মেন্ট শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াই। কারন তাদের হাতে টাকা থাকলে জাতীয় ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তাদের বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য শিক্ষক লাগবে। বহুভাবে অনেক কর্মসংস্থান হবে, আমি আপনি অপমান অপদস্থ না হয়ে সন্মানজনক কাজের সুযোগ পাবো। 

লেখকঃ উৎসব মোসাদ্দেক
সংগঠক, গণসংহতি আন্দোলন
সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন

তথ্য সূত্র:
বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত হাবিবা জান্নাতের সাক্ষাৎকার,
১৫.০৪.২০১৬।
দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদন
০৮ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে প্রকাশিত।

Leave a Reply