“গামারে গামা, মাহবুবরে থামা
লেনিন গামা, নূরা পাগলারে থামা”১
১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বা মধুর ক্যান্টিনে একটি অতি উচ্চারিত স্লোগানটি স্মরণ করিয়ে এই সর্বব্যাপী বিস্মরণের কালে ইতিহাসের কিছু পরিহাস তুলে ধরতে চাই। স্লোগানের লেনিন মানে নূহ উল আলম লেনিন ২ আর গামা মানে ইসমাত কাদির গামা৩। লেনিন ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা, আর গামা মুজিববাদী ছাত্রলীগের। ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ প্যানেল দিয়েছিল জাসদ ছাত্রলীগের প্যানেলের জনপ্রিয়তায় ভয় পেয়ে। আজকের মতো তখনও জোট রাজনীতি চলেছিল, জাতীয় রাজনীতিতে ছিল সিপিবি-আওয়ামী লীগ-ন্যাপের ত্রিদলীয় ঐক্যজোট বনাম নবগঠিত জাসদের লড়াই।
মুক্তিযুদ্ধের গনগনে স্মৃতিওয়ালা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তখন ছাত্র ইউনিয়ন-মুজিববাদী ছাত্রলীগ বনাম জাসদ ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা প্রমাণের প্রতিযোগিতা। এই স্লোগানে ‘নূরা পাগলা’ বলে যাকে খেপানো হচ্ছে, তিনি ছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের আ ফ ম মাহবুবুল হক ৪। তিনি ছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী। অর্থনীতি বিভাগের এই মেধাবী ছাত্র ছিলেন অসম্ভব ক্যারিশম্যাটিক, চে গুয়েভারার মতো চলন-বলন, মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফ। ক্যাম্পাসে তার পোশাক-আশাকও তখনকার তরুণরা নকল করত। ওই সময় হাইকোর্টের মাজারে নূরু নামে একজন জনপ্রিয় ‘পাগল’ ছিলেন।
বিপক্ষ দলীয়রা আ ফ ম মাহবুবুল হককে হেয় করতে ‘নূরা পাগলা’ বলে খেপাতে শুরু করেছিল। আসলেই ‘লেনিন-গামা পরিষদ’ নূরা পাগলাদের ‘মাহবুব-জহুর পরিষদ’কে থামিয়েছিল, তবে তা ভোটের পথে নয়। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন শেষে প্রথমে হলগুলোর ভোট গণনা শেষে যখন দেখা যায় আ ফ ম মাহবুবুল হকের ক্যারিশম্যাটিক জনপ্রিয়তায় ভর করে জাসদ ছাত্রলীগ হলে একচেটিয়াভাবে জিতেছে, তখন সন্ধ্যার দিকে ডাকসুর ব্যালট বাক্সগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারি মদতে ছিনতাই করা হয় ৫, ৬। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সামনেই ঘটনাটি ঘটে। কেউ প্রতিবাদ করেছেন বলে শোনা যায়নি। ‘নূরা পাগলা’ আ ফ ম মাহবুবুল হক হতে পারতেন এই সোনার বাংলা গড়ার কারিগর, অথচ সারাজীবন আনসাং হিরো হয়ে নিভৃতেই চলে গেছেন তিনি। অজ্ঞাতনামা (!) আততায়ীর হাতে মারাত্মকভাবে মাথায় আঘাত পেয়ে দীর্ঘদিন রোগে ভুগে গত ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর তারিখে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
স্বাধীনতার আগে ৬৮-৬৯ মেয়াদে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা আ ফ ম মাহবুবুল হক মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করতে গিয়ে হয়ে উঠেছিলেন জনগনের ‘নূরা পাগলা’। আন্দোলনের আগুন যে মাটির মানুষগুলোকে পুড়িয়ে খাঁটি করে তোলে সোনা বানায়, তারা আগের মতো ‘সাধারণ’ থাকেন না। তারা আর আগের মতো ‘দলীয়’ হতে পারেন না। অসংখ্য আদম সন্তান যখন মুক্তির আশায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, বিজয়ের আনন্দলোকে জাড়িত হয়— দুনিয়ার যেকোনো কায়েমি দানবীয় শক্তিও অসহায় হয়ে কাঁপতে থাকে। যেমনটা অধুনার ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সামনে কায়েমি স্বার্থের সরকারকে দেখা গেছে। সেই মোমেন্টাম যারা একবার দেখে ফেলেন, তারা জেনে যান মানুষের মহত্তম ক্ষমতাটি, দেখে ফেলেন মানুষের হিংস্র-কুটিল চেহারাটিও। আর তাই ১৯৭২ সালে ‘নুরা পাগলা’ আ ফ ম মাহবুবুল হক রণাঙ্গন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যখন ফিরেছিলেন, তখন কায়েমি দানবীয় হয়ে উঠতে থাকা ছাত্রলীগকে তিনি আর ধারণ করতে পারেননি।
১৯৭৩ সালে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে দুইটি উল্লেখযোগ্য নির্বাচন হয়েছিল— প্রথম সংসদীয় নির্বাচন আর ডাকসু নির্বাচন। আজকের দিনের বিনাভোটে নির্বাচিত হওয়ার মতোই সেবারও প্রথম সংসদ নির্বাচনে জিতে গেছিলেন (নাকি জেতানো হয়েছিল?) তোফায়েল আহমেদসহ অনেক বাঘা বাঘা নেতাকে। খন্দকার মুশতাককে জেতানোর জন্য হেলিকপ্টারে করে ব্যলট বাক্স ছিনতাই করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল বলে জনশ্রুতি আছে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখে নির্ধারণ করা হয় ডাকসু নির্বাচনের তারিখ। ২০২৩ সালে আসন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালে এসে এখন বোঝা যায় ১৯৭৩ সালের একচেটিয়াতন্ত্র কেমন ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান থেকেই জেনে নেওয়া যাক ১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কী কী ঘটেছিল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার বইয়ে বর্ণনা দিচ্ছেন, “…বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে মুজিববাদীদের পক্ষে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। ভেতরে ভেতরে ছিলও বটে। কিন্তু নির্বাচনের দিন ফলাফল যখন আসতে শুরু করল তখন দেখা গেল অবিশ্বাস্য ঘটনা। সব হলেই বিরোধীরা জয়ী হয়েছে। অথচ সারাদিন এলাকাজুড়ে শোনা গেছে শুধু ‘লেনিন-গামা, লেনিন-গামা’ ধ্বনি, ঝালাপালা হয়ে গেছে ক্যাম্পাসের কান! লেনিন-গামার সমর্থকরা দৃশ্যমান ব্যাজ পরে সর্বত্র ঘোরাঘুরি করেছে, নিশ্চিত বিজয়ের উল্লাসে। অথচ নিরবে ব্যালটবিপ্লব ঘটে গেছে। অনেকটা সত্তরে ছয় দফার বিজয়ের মতোই। লেনিন-গামার ব্যাজ পরেও মাহবুব-জহুরকে ভোট দিয়ে গেছে ছেলেমেয়েরা।”
“মুজিববাদীরা তখন আর বিলম্ব করেনি, ছিনতাই শুরু করে দিয়েছে। হলগুলোতেই গণনার কাজ হয়েছে প্রথমে। ডাকসুর গণনাটা হবে সব শেষে, সন্ধ্যার পরে, যখন ডাকসুর নির্দিষ্ট ব্যালট বাক্সগুলো সেখানে নেওয়া ও খোলা হবে। হলের ফল দেখেই তো কোনো সন্দেহ রইল না যে ডাকসুর ফল কী হবে। কাজেই সেখানেও একই ঘটনা ঘটল। কলাভবনের চার তলায় গণনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। হঠাৎ করে সব বাতি নিভে গেল এবং পেছনের সিঁড়ি দিয়ে কে বা কারা এসে ব্যালট বাক্সগুলো নামিয়ে নিয়ে চলে গেল। দুয়েকটা বোমা বিস্ফোরণও বোধ করি ঘটেছিল। যদিও তার প্রয়োজন ছিল না। কেননা প্রতিরোধ করার মতো কেউ তো ছিল না। বিপক্ষ দলের ছেলেরা তখন আত্মরক্ষার জন্য নিজেদেরকে অপ্রকাশ্য করে তুলেছে। চার তলার হল ঘর থেকে আমরা নিচে নেমে এলাম। উপাচার্যও আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। কলাভবনের সামনে দেখলাম চিফ রিটার্নিং অফিসার প্রফেসর ওদুদুর রহমান তার গাড়িতে চড়ছেন। তারা কোথায় যাচ্ছেন— এ ব্যাপারে কৌতূহল ছিল। কে যেন বলল, ৩২ নম্বরে। ওই যাত্রার সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে এটা তো সত্য— ১৯৭৪ (ডাকসু নির্বাচন আসলে হয়েছিল ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩)-এর শুরুতে ডাকসুর সেই ব্যালট ছিনতাই এই ভয়াবহ বাণী দেশবাসীর কানে পৌঁছে দিল যে দেশে গণতন্ত্রের পথটা সুগম হবে না। হয়ওনি। বহু ঘটনা ঘটেছে, ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর অতি অবিশ্বাস্য সব ঘটনা। কিন্তু সূত্রপাত মনে হয় ডাকসুর ওই নির্বাচন বানচালের ব্যাপারটা থেকেই।” (দুই যাত্রায় এক যাত্রী (২য় খণ্ড), পার্ল পাবলিকেশন্স, ২০১০, ঢাকা)
সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেওয়া হয়েছিল। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসা অথবা পল্টনের অফিসগুলোতেই তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো, এখনো যেমন নেওয়া হয়! আজন্ম গণতন্ত্রের জন্য আত্মত্যাগ করা একটা জাতির আতুঁড় ঘরেই বিকাশমান গণতন্ত্রকে মুখে নুন দিয়ে ১৯৭৩ সালেই মেরে ফেলা হয়েছিল। ‘নূরা পাগলা’কে ঠিক থামানো গেছিল, কিন্তু বাংলাদেশকে কি চালানো গেছে আর? ঠিক কী কী বাঁচাতে বা চালু রাখতে ‘মাহবুব –জহুর’দের থামাতে হয়েছিল? প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের কলঙ্কতিলক এই ঘটনার কুশীলব আর সাক্ষী-সাবুদ অনেকেই বেঁচে নেই, যারা আছেন চুপ করে আছেন, সত্যের মুখোমুখি হতে চান না। ব্যতিক্রম একজন অবশ্য মিলেছে— বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
১৯৭৩ সালে সেলিম ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ডাকসু ভিপি। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ভিয়েতনাম দিবসের মিছিলে প্রেস ক্লাবে গুলি চালিয়ে মতিউল-কাঁদেরের মৃত্যু নিয়ে ভীষণ বিক্ষুব্ধ ঢাকায় উত্তপ্ত জনসমাবেশে ডাকসু ভিপি হিসেবে ২ জানুয়ারি আজীবন সদস্যপদ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বহিষ্কারের ঘোষণা দেন এবং সদস্যপদ বই থেকে সংশ্লিষ্ট পাতাটি ছিঁড়ে ফেলেন সেলিম। তিনি ডাকসুর পক্ষ থেকে দেওয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটিও প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে বলেন, এখন থেকে সেটি আর ব্যবহার করা যাবে না।
ইতিহাসের এই পর্বটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক ও বিস্ময় জাগানিয়া। ৩ জানুয়ারি থেকে পার্টি অফিসে হামলা দিয়ে ছাত্রলীগ শুরু করে সারাদেশে নিপীড়নের স্টিম রোলার চালিয়ে দেয়, খোদ গোপালগঞ্জেই ১০ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমরেড লেবু ভাই এবং কমলেষ বৈদ্যকে হরর ফিল্মের মতো হিংস্রতার মাধ্যমে খুন করা হয়। ২০১৮ সালে ছাত্র আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগের যে রূপ দেখা গেছে, তাতে ১৯৭৩ সালের পরিস্থিতি বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় কারও। তবে এর ঠিক আট মাস পরেই ৩ সেপ্টেম্বর আক্রান্ত ও আক্রমণকারী দল দুইটি ‘লেনিন-গামা’ পরিষদ নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় মিললেন কিভাবে— তা দম আটকে আসার মতো বিস্ময়কর বিষয়!
২০০৯ সালের ২৩ অক্টোবর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডাকসু নির্বাচনে বাধা ও করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা আয়োজন করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘যোগাযোগ ইশকুল’। অনেক সাবেক-বর্তমান ছাত্রনেতাদের মধ্যে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং মাহমুদুর রহমান মান্নাও ছিলেন। দু’জনই ১৯৭৩ সালের ইতিহাসে অন্যতম কুশীলব ছিলেন। সেলিম আট মাস আগের তীব্র দুঃখ ও প্রতিশোধ ভুলে ‘লেনিন-গামা’রে দিয়ে ‘নূরা পাগলা’ আ ফ ম মাহবুবুল হককে ঠেকানোর কাজে যথাসাধ্য করেছেন। অন্যদিকে মান্না মাহবুব-জহুর পরিষদের পক্ষে লড়াই লড়েছিলেন। ম ই সেলিম তার সেই পুরনো ভুলের স্বীকারোক্তি ২০০৯ সালে এসে দিয়েছিলেন এভাবে— ২০০৯ সালের ২৩ অক্টোবর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডাকসু নির্বাচনে বাধা ও করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা আয়োজন করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘যোগাযোগ ইশকুল’। অনেক সাবেক-বর্তমান ছাত্রনেতাদের মধ্যে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং মাহমুদুর রহমান মান্নাও ছিলেন। দু’জনই ১৯৭৩ সালের ইতিহাসে অন্যতম কুশীলব ছিলেন। সেলিম আট মাস আগের তীব্র দুঃখ ও প্রতিশোধ ভুলে ‘লেনিন-গামা’রে দিয়ে ‘নূরা পাগলা’ আ ফ ম মাহবুবুল হককে ঠেকানোর কাজে যথাসাধ্য করেছেন। অন্যদিকে মান্না মাহবুব-জহুর পরিষদের পক্ষে লড়াই লড়েছিলেন। ম ই সেলিম তার সেই পুরনো ভুলের স্বীকারোক্তি ২০০৯ সালে এসে দিয়েছিলেন এভাবে— ‘ডাকসু নির্বাচন হবে, যদি আমরা পরাজয় মানতে রাজি থাকি। ১৯৭৩-এ আমরা পরাজয় মেনে নিতে রাজি ছিলাম না, তাই আমরাই ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছিলাম। আজ আমি আপনাদের সামনে স্বীকার করছি, সেদিন আমরা অন্যায় করেছিলাম। আমি ঘটনা জানতাম না, তাই ঘটনার জন্য জাসদকে দায়ী করে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলাম। আজ আমি এ-ও স্বীকার করছি, আমি ভুল বলেছিলাম। ছিনতাই জাসদ করেনি, করেছিল ছাত্রলীগ।’৭
এত বছর পর অনুতাপ করে বা ক্ষমা চেয়ে কী লাভ? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতুড়ি মামুন যদি ২০৫০ সালে রাবির ছাত্র তরিকুলের গাইবান্ধার বাড়িতে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে কাঁদেও, তাতে কিছু যাবে-আসবে কি? ক্ষতি যা হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে। তোফায়েল আহমেদ, শেখ শহীদুল ইসলাম, নূর ই আলম সিদ্দিকী প্রমুখ বেঁচে আছেন। ১৯৭৩ সালের দুই নির্বাচন নিয়ে, কমরেড লেবু ভাইদের নিয়ে, বামপন্থী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা নিয়ে। অন্তত প্রকাশ্য কোনো ফোরামে বলেন না। ম ই সেলিম তবু তো প্রকাশ্য কোনো ফোরামে অন্তত একবার হলেও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। রাজনৈতিক সততা ও সাহসের একটা নজির তৈরি করেছেন। কিন্তু ঠিক কী কী বিবেচনায় বিপুল সাংগঠনিক ভিত্তি লোকবল থাকা সত্ত্বেও ছাত্রলীগকে ছাড় দিয়েছিল ছাত্র ইউনিয়ন? ম ই সেলিমের এখন ঐতিহাসিক কর্তব্য সেটাই তুলে ধরা।
১৯৭৩ সালে জনাব সেলিম ও তার সিনিয়র নেতাদের ‘বিবেচনা’ নিয়ে নির্মোহ পর্যালোচনা আমাদের আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক নতুন দিশা হাজির করতে পারে। হাতুড়ি-হেলমেট বাহিনীর পৃষ্ঠপোষক, নববর্ষের নারী নিগৃহকারীদের জন্মদাতা, নির্যাতনবিরোধীদের ওপর হামলা, কিংবা সুন্দরবন রক্ষার সাইকেল মিছিলে যারা হামলাকারী, তাদের ঠেকাতে ডাকসুতে কেন আরেকটি মাহবুব-জহুর প্যানেলের মতো আরেকটি অপ্রতিদ্বন্দী প্যানেল হলো না? প্রগতিশীল ছাত্র জোট, কোটা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, নির্যাতনবিরোধী শিক্ষার্থীরা মিলে কেন হেলমেট-হাতুড়িবিরোধী একাট্টা প্যানেল কেন হলো না? ২০১৮ সালজুড়ে চলা এত নিপীড়ন-নিগৃহের উপযুক্ত জবাব দিতে সারাদেশে নিপীড়িত নিশ্চুপদের কাছে জনপ্রিয় কোটা আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে মিলতে বাধা হয়ে দাঁড়াল আজকের কোন কোন ‘বিবেচনা’? আজকের ছাত্রনেতারা যে রাজনৈতিক ‘বিবেচনায়’ পুরো ২০১৮ সাল জুড়ে চলা হাতুড়ি হেলমেট, নববর্ষের নারী নিগৃহ, মিছিলে মিছিলে ছাত্রলীগের হামলা ভুলে যেতে পারেন, ১৯৭৩ সালে সেলিমেরা সম্ভবত সেই একই রকম বিবেচনায় মতিউল-কাদেরের মৃত্যু, কমরেড লেবু ভাইদের হত্যাকাণ্ড আর দেশব্যাপী পার্টি নেতাদের ওপর হওয়া হামলা হজম করে ফেলে ছাত্রলীগের সাথে ভোট ডাকাতিতে অংশ নিয়েছিলেন।
সবাই অবশ্য এরকম সহজে ভুলতে পারেনা সংগ্রামের ইতিহাস, আফম মাহবুবুল হকদের মতো আপোষহীন লোকেরা তাই এতো সহজে কায়েমি মহলে জড়াতে পারেননা। একারণেই হয়তো তিনি সমকালীন চলচ্চিত্রের ট্রাজিক হিরো হন, তাঁর আরাধ্য চে গুয়েভারার মতোই! তবে এটা সুনিশ্চিত যে, ইতিহাসের নির্মোহ পাঠ ভাবী প্রজন্মের কাছে ভিলেনদের ভীড় থেকে সময়ের বীরদের ঠিকই আলাদা করে উর্ধ্বে তুলে ধরবে।
তথ্যসূত্র :
১. ‘স্লোগানে স্লোগানে রাজনীতি’; আবু সাঈদ খান, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৮
২. Nooh Ul Alam Lenin: https://www.facebook.com/noonul.alamlenin/timeline?lst=100000007508754%3A100006588698931%3A1551816586
৩. Ismat Quadir Gama: https://www.facebook.com/profile.php?id=100013684729203&lst=100000007508754%3A100013684729203%3A1551816403&sk=timeline
৪. আফম মাহবুবুল হকঃ
৫. মাহমুদুর রহমান মান্না সাপ্তাহিক পত্রিকায় সালে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকার
“……সাপ্তাহিক: আপনার ওপর আঘাতের ঘটনার প্রতিক্রিয়া কী হলো?
মাহমুদুর রহমান মান্না: মিছিল-প্রতিবাদ সভা সবই হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ছেলের নির্দেশে এ ঘটনা ঘটেছে। তাকে তো আর অ্যারেস্ট করবে না পুলিশ। তারপর যেমন ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট বাক্স হাইজাক হলো।
সাপ্তাহিক: ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে আপনাদের প্রার্থী কারা?
মাহমুদুর রহমান মান্না: আমি তখন জাসদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। ডাকসু’তে ভিপি পদে আমাদের প্রার্থী ছিলেন আ ফ ম মাহাবুবুল হক। আর আমাদের একবছরের সিনিয়র জহুর ভাই, উনি ছিলেন জিএস ক্যান্ডিডেট। বিপরীতে মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেল ছিল লেনিন-গামা পরিষদ। ছাত্র ইউনিয়নের নূহ-উল আলম লেনিন ভিপি এবং ইসমত কাদির গামা ছাত্রলীগের পক্ষে জিএস ক্যান্ডিডেট। ওই নির্বাচনের দিন দুপুর ১২টা-১টার দিকে, সূর্যসেন হলে আমাদের কন্ট্রোল রুম ছিল। ওখানে এসে ছেলেরা জানাল, শহীদুল্লাহ হলে পুরো বুথ দখল করে শেখ কামাল তার লোকজনসহ ব্যালট পেপারে সিল মারছে। আ ফ ম মাহাবুবুল হক ভাই বললেন ওখানে যাও। আসলাম। শহীদুল্লাহ হলের কমন রুমের পাশের রাস্তাটায় দাঁড়িয়েছি। সঙ্গে সঙ্গেই, মিনিট তিন-চারেকের মধ্যেই হৈ হৈ করতে করতে একদল এলো, গালাগালি, ধর ধর… এরকম অবস্থা। আমার সঙ্গে যারা ছিল, দৌড় দিয়ে ভয়েই পালিয়ে গেছে। আমি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি। দৌড় দিলে কেমন লাগে! আমি দাঁড়ালাম। ওরা কয়েকজন এসে চারদিক থেকে আমাকে ঘিরে ধরল। সবার হাতে স্টেনগান। আমাকে ধরে এখন বিপদে পড়ে গেছে। এমনিতে আমাদের কর্মীদের দু-চারটা চড় থাপ্পড় দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন আমার গায়ে হাত তুলবে কি না, বুঝতে পারছে না। আমি আটকে গেছি। এটা দেখে প্রথমাবস্থায় দৌড় দিয়ে চলে যাওয়া আমাদের কর্মীরা আবার ফিরে আসছে। এটাতে একটা হুটোপুটি লেগে গেল এবং কেউ একজন আমাকে ধরে বলল, ভাই চলেন। বেরিয়ে আসলাম। আমি বুঝলাম যে ওরা যেটা করার করবে, কিন্তু আমাকে হয়তো শারীরিকভাবে আঘাত করতে চায়নি, বেরুবার একটা পথ তৈরি করার জন্যই এই হুটোপুটিটা করল। রাতে তো ব্যালট বাক্স সব হাইজ্যাক হয়ে গেল। ওরা বলল, এটা জাসদ ছাত্রলীগ করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি মতিন চৌধুরী ওরকম একটা ভূমিকা রাখলেন তাদের অনুকূলে। ১৯৭৩ সালে ডাকসু’র নির্বাচনে ব্যালট বাক্স তখনকার সরকারি পক্ষ ছিনতাই করেছিল। ওই নির্বাচনের সময় আমরা ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলাম। যে রকম হল থেকে দু’টো-চারটা রেজাল্ট আমরা পেয়েছিলাম, তার ভিত্তিতে আমি একথা বলছি। কারণ, সারাদিন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ভোট উপলক্ষে ঘুরছি। ভোটারদের রিঅ্যাকশনটা দেখেছি। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তখন যতগুলো ডিপার্টমেন্ট ছিল, প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড স্থানকারী শিক্ষার্থীরা বিবৃতি দিয়ে আমাদের প্যানেল সমর্থন করেছিল। জাসদ ছাত্রলীগের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন তখন ছিল প্রশ্নাতীত। সেই নির্বাচন হাইজ্যাক হয়ে গেল। রেজাল্ট করতে দিল না। উল্লেখ করার মতো এই ঘটনা। এছাড়া কুখ্যাত সেভেন মার্ডার ঘটনা তো সবার জানা আছে। এক অর্থে ক্যাম্পাসে একটা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল মুজিববাদী ছাত্রলীগ।
৬. মহিউদ্দিন আহমদ: ১৬ আগস্ট ২০১৫ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে ‘ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার জন্য অভিনন্দন’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে (https://www.prothomalo.com/opinion/article/603784) সিপিবি সভাপতি ম ই সেলিমসহ তৎকালীন নেতৃত্বের ভূমিকা আলোচনা করেছেন।
৭. ‘প্রসঙ্গ ডাকসুঃ নির্বাচনে বাধা ও একটি অকপট স্বীকারোক্তি’ মাহমুদুর রহমান মান্না। দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত নিবন্ধ। তারিখ: ১০-১১-২০০৯ (http://archive.prothom-alo.com/section/date/2009-11-10/category/92)
লেখক: আব্দুল আলিম, সদস্য, জাতীয় পরিষদ , গণসংহতি আন্দোলন।
#১১/১/উম